ঢাকা আর্চডাইয়োসিসের জন্য আর্চবিশপের পালকীয় পত্র

মে ৭, ২০২০

বরাবর: যাজক, সন্ন্যাসব্রতী ও ভক্তজনগণ
ঢাকা আর্চডাইয়োসিস

 ঢাকার আর্চবিশপের পালকীয় পত্র

খ্রিস্টেতে প্রিয়জনেরা,

প্রথমেই আপনাদের সবাইকে আমার শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভালবাসা জানাই। সাম্প্রতিক দুর্যোগকালের জীবন সংগ্রামে, অনেক বিশ্বাস, ভালবাসা ও আশা নিয়ে আপনারা সকলে খ্রিস্টবিশ্বাসী হয়ে জীবন যাপন করছেন তার জন্য প্রভুর প্রশংসা করি এবং আপনাদের সবাইকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই। বিশ্বাসের পরীক্ষায় একদিন পূর্ণভাবে জয়ী হবে, সেটাই আমাদের বিশ্বাস।

সাম্প্রতিক সকল বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্বের মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের মধ্যে বিশেষ সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে। এই সেতুবন্ধন শুধু সামাজিক পর্যায়েই নয়, বরং আধ্যাত্মিকভাবেও আমাদেরকে পরস্পরের অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। অনলাইনে খ্রিস্টযাগ অর্পণ ও ঘরে বসে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ সত্যিই আমাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা ও জীবন্ত বিনিময়।

(১)  করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহা-দুর্যোগে একদিকে উপলব্ধি করছি যে, আমাদের জীবনযাত্রা ও জীবননির্বাহ কত কষ্টকর ও কঠিন হয়ে আছে সবার জন্য।  এই দুঃসময় ও দুর্দিনে পুনরুত্থিত প্রভু যিশুর উপস্থিতি ও তাঁর ওপর নির্ভর করে, আপনারা প্রায় সবাই ঘরে ঘরে খ্রিস্টবিশ্বাসের জীবন যাপন করছেন।  প্রতিটি ঘর ও পরিবার যেন ক্ষুদ্র মণ্ডলী  হওয়ার প্রক্রিয়ায় আরও অনেক সোচ্চার।  প্রতিটি পরিবার হয়ে উঠছে খ্রিস্টীয় জীবনের পুণ্য-সাধনালয়, ধর্ম-শিক্ষালয় এবং দুঃখীদের সেবালয়।  এই ক্ষেত্রে আপনাদের দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা ও সাক্ষ্যদানের জন্য অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।  ঈশ্বর অশুভ ও মন্দের মধ্য থেকে বের ক’রে আনেন অনেক শুভমঙ্গল।  তাঁর সাক্ষ্য-প্রমাণ আমরা অনেক দেখেছি।

(২) বর্তমানে আমরা মে মাস বা কুমারী মারীয়ার একটি বিশেষ মাসে অবস্থান করছি।  মে মাসের শুরুতে আমাদের পুণ্যপিতা পোপ মহোদয় বলেছিলেন:

মে মাসটি এমন এক বিশেষ সময় যখন খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ বিশেষ গুরুত্বের সাথে ধন্যা কুমারী মাতা মারীয়ার প্রতি তাদের ভালবাসা এবং ভক্তি প্রকাশ করতে এই মাসে পরিবারের মধ্যে রোজারি প্রার্থনা একটি ঐতহ্যিগত বিষয়। করোনা ভাইরাস মহামারীটির বিধিনিষেধে আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ ধেকেও এই “পরিবার” বিষয়টিকে আরও বেশি উপলব্ধি করতে আমাদের বাধ্য করেছে। এই কারণে আমি মে মাসে বাড়িতে রোজারি প্রার্থনা করার সৌন্দর্য পুনরায় আবিস্কার করতে সবাইকে উৎসাহিত করতে চাই।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাদের মাতা মারীয়ার হৃদয় দিয়ে খ্রিস্টের মুখাবয়বের কথা ধ্যান করা আমাদেরকে আধ্যাত্মিক পরিবার হিসেবে আরও বেশি করে একীভূত করে তুলবে এবং আমাদেরকে এই কঠিন সময়কে কাটিয়ে ওঠতে সহায়তা করতে আমি আপনাদের সবাইকে আমার প্রার্থনায় স্মরণ করব, আমার জন্যও প্রার্থনা করবেন।

(৩) “মানবিক ভ্রাতৃত্ব বিষয়ক উর্ধ্বতন কমিটি”  কর্তৃৃক  প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস, সর্বধর্মের বিশ্বাসীদের আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রকাশস্বরূপ,  আগামী ১৪ মে, বৃহস্পতিবার দিবসটি, “প্রার্থনা, উপবাস ও দয়ারকাজ”- এর বিশেষ দিবস রূপে একযোগে পালন করার জন্য বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন। এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হবে, চলমান করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারিকে জয় করার জন্য বিশ্বমানবজাতিকে সাহায্য করা।

পোপ মহোদয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আসুন আমরা, ঢাকা আর্চডাইয়োসিসে প্রতিটি ঘরে,  প্রার্থনা, উপবাস ও দয়ারকাজ বা সাহায্যদানের চেতনায় দিবসটি পালন করি।  উল্লেখ্য যে, ঐদিন আমাদের আর্চডাইয়েসিসের যাজকবৃন্দ, নির্জনধ্যান ক’রে প্রার্থনা ও উপবাসের মধ্য দিয়ে জনগণের সাথে আত্মিকভাবে একাত্ম হয়ে, উক্ত দিবসটি অর্থপূর্ণভাবে পালন করবেন।

(৪) বিগত ৩০ মার্চ, ঢাকা আর্চডাইয়োসিসের জন্য করোনা মহামারিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আক্রান্তদের মাঝে দয়ার কাজ বা সাহায্যদানের জন্য “করোনা চ্যারিটি ফাণ্ড“ করার উদ্দেশ্যে সবার কাছে আমি আবেদন জানিয়েছিলাম। উক্ত আবেদনে সাড়া দিয়ে অনেক সন্ন্যাসব্রতী সংঘ, ধর্মপল্লীর জনগণ, কারিতাস বাংলাদেশ, খ্রিস্টান সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সামর্থ অনুসারে এগিয়ে এসেছেন যার ফলে ধর্মপল্লী পর্যায়ে অভাবীদের মাঝে সাহায্য বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি খ্রিস্টান সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এই দুঃসময়ে অভাবীদের পাশে দাঁড়িয়ে আপনারা অভাবী প্রতিবেশীর প্রতি প্রেম প্রদর্শন করেছেন, তার জন্য আপনাদের সবার কাছে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

আর্চডাইয়োসিসের “করোনা চ্যারিটি ফাণ্ড “ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি টিম প্রথম ধাপে, ২৫টি ধর্মপল্লীতে ৮১১টি পরিবারকে, স্থানীয় এসভিপি ও পালকীয় পরিষদের মাধ্যমে সাহায্য প্রদান করে।  দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা কারিতাস ও আর্চডাইয়োসিসের যৌথ প্রচেষ্টায়, ১৪ মে দিবসটির ফলশ্রুতি হিসেবে, আরও প্রায় ১৮০০ পরিবারকে, ১৫ মে থেকে দয়ারকাজের অংশ স্বরূপ ২৬টি ধর্মপল্লীতে অতি দরিদ্রদের জন্য সাহায্য বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।  আর্চডাইয়োসিসের করোনা চ্যারিটি ফাণ্ডে নিজস্ব সামর্থ অনুসারে অর্থদানের জন্য আরও সাহায্যের আবেদন জানাই।

(৫) পাঁচ বছর পূর্বে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস পৃথিবীর যত্ন ও পরিবেশের উপর একটি সার্বজনীন পত্র লিখেছিলেন।  পত্রটির নাম  “লাউদাতো সি” অর্থাৎ “হোক তব প্রশংসা”।  এই পত্রটি বিশ্বে একটি যুগান্তকারী ঘটনা রূপে বহুল স্বীকৃতি লাভ করেছে।  বর্তমানের বৈশ্বিক করোনা মহামারির তাণ্ডব ও দুর্যোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশের বিপর্যয়।  সর্বজনীন পত্রটি প্রকাশের পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে “লাউদাতো সি Ñ সপ্তাহ”(১৬-২৪ মে, ২০২০) পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উক্ত উদযাপন উপলক্ষে পোপ মহোদয়, অতি জরুরীভাবে পৃথিবীটাকে রক্ষা করার জন্য বাস্তব কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর আর্তনাদ ও গরিবদের কান্না শোনার জন্য আবার তিনি আকুল আবেদন করেছেন। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য “সর্বসাধারণের বসতবাটি পৃথিবীটা” কীভাবে রেখে যাব, তা জরুরী ভাবে ভাবতে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রত্যেকের কাছে তিনি আবেদন জানাচ্ছেন।

পুণ্যপিতা পোপ মহোদয়ের সাথে একাত্ম হয়ে, মে মাসের ১৬-২৪ তারিখ “লাউদাতো সি”  সপ্তাহ উদযাপন করার অনুরোধ আমরা সবাইকে জানাচ্ছি।  উক্ত উদযাপন উপলক্ষে আমরা পরিবেশ ও সৃষ্টির যত্ন নেওয়া সম্বন্ধে সচেতন হব এবং সেই উদ্দেশ্যে যে-সমস্ত কর্মকাণ্ড আমরা অতি সহজে হাতে নিতে পারি তা গ্রহণ করব, যেমন:  (১) পরিস্কার-পরিচ্ছনতা – নিজের দেহ থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, সমাবেশস্থল, প্রভৃতির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা; (২) জিনিসপত্র ও দ্রব্যসামগ্রীর অপব্যবহার, অপচয় ও ভোগের মানসিকতা বর্জন; (৩) সকল প্রকার দূষণ – শব্দ, বায়ূ ও জল-  ইত্যাদির দূষণ থেকে বিরত থাকা; (৪) প্রয়োজন-অতিরিক্ত খরচপাতি, ভোগবিলাস, ভোজনবিলাস, সকল প্রকার অপচয় থেকে বিরত থাকা; (৫) প্রকৃতিজাত, বিশুদ্ধ ও সুষম খাদ্য আহার ও পানীয় পান করা।  স্মরণে রাখতে হবে যে, যান্ত্রিক উন্নয়নই মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন নয়; মানবিক উন্নয়ন সর্বদাই সমন্বিত। সেই উন্নয়নে আমরা সবাই নিষ্ঠ ও ব্রতী হই।

পরিশেষে, মে মাসের শেষদিন পঞ্চাশত্তমী পর্ব, অর্থাৎ পবিত্র আত্মার অবতরণ পর্ব।  পবিত্র আত্মাকে আমাদের দেওয়া হয়েছে যেন আমরা খ্রিস্টের প্রিয় শিষ্য হতে পারি, তার শক্তিতে আমরা যিশুর সাক্ষ্যবহন করতে পারি, এবং তাঁর সৃজনী শক্তিতে আমার যেন নতুন পৃথিবী ও নতুন সৃষ্টির কারিগর হয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টি অবাহত রাখতে পারি। আমাদের বদ্ধগৃহে, কুমারী মারীয়াকে আমাদের মাঝখানে রেখে আসুন, আমরা সবাই পবিত্র আত্মার অবতরণের প্রতীক্ষায় প্রার্থনারত থাকি।

 

খ্রিস্টেতে সেবারত,

কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি

আর্চবিশপ, ঢাকা আর্চডাইয়োসিস।