Categories Uncategorized

‘লাউদাতো সি’ বা ‘তোমার প্রশংসা হোক’ সপ্তাহে করণীয়

আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে

মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস এর সর্বজনীন পত্র  ‘লাউদাতো সি’ বা

‘তোমার প্রশংসা হোক’ এর অনুপ্রেরণায় কিছু সুপারিশমালা

ফাদার ড. লিটন হিউবার্ট গমেজ, সিএসসি

 

১. পোপ ফ্রান্সিস এর আহ্বানে  ‘লাউদাতো সি বা তোমার প্রশংসা হোক সপ্তাহ’ ১৬-২৪ মে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ আরম্ভ করেছি। অবরুদ্ধ সময়ে পরিবারে সদস্যরা একত্রে অথবা কর্মস্থলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিটিং বা আলোচনার পূর্বে কিছু সময় সৃষ্টিকর্তার নিকট সৃষ্টির অসংখ্য দানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ও যতœবান হওয়ার জন্য প্রার্থনা করি। অন্তরে গভীরভাবে উপলব্ধি করি- আবর্জনা এখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে অপরিচ্ছন্ন-অস্বাস্থ্যকর নর্দমা তৈরি করেছি; গাছ কেটেছি কিন্তু রোপনে অবহেলা করে পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট করেছি; স্বার্থপর ও অতিভোগের কারণে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ করে ফেলেছি; প্রতিনিয়ত প্রচুর পানি অপচয় করছি, খাল-নদীর জল বিষাক্ত করে ফেলেছি; এভাবে প্রকৃতি ও প্রতিবেশীদের প্রতি অনেক ক্ষতি  ইতোমধ্যে করেছি। এসব স্মরণ করে অনুতপ্ত হই ও মন-পরিবর্তন করে প্রকৃতি ও  প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলি।

২. আমাদের পরিবার হল সৃষ্টি ও প্রকৃতির একটি অংশ । পরিবার যত্ন নিয়ে থাকে সৃষ্টি ও প্রকৃতির এবং পরিবার বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপকরণসমূহ প্রকৃতি সরবরাহ করে থাকে। তাই দায়িত্বশীল পরিবার গঠন, সুন্দর জীবনযাপন, স্বামী-স্ত্রীর অঙ্গিকার রক্ষা, বিপদাপন্ন আপনজনদের সেবায করে পারিবারিক পরিবেশ সুন্দর করে তুলতে পারি। পরিবারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, প্রয়োজন মাফিক কেনাকাটা, পরিমিত রান্না ও অপচয়রোধ, পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস, জিনিসপত্র পুনঃব্যবহার করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহযোগিতা করতে পারি। বাড়িতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিভিশন, এসি, পানির কল, বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহারের পর বন্ধ রাখাতে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশ, পাতা-লতা ও আবর্জনাগুলি মিশ্রিত করে উত্তম সার তৈরি করা যায় এবং এসব গাছের বৃদ্ধিতে আরও ভাল সার হিসেবে সহায়তা করে।

৩. শুধু পরিবারের মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করলে স্বার্থপর হয়ে উঠব; বরং বনের জীব-জন্তু, আকাশের পাখি, বাতাসে উড়ে বেড়ানো মশা-মাছি, ভূমির পোকা-মাকড় ও সরিসৃপ, নদী ও জলাভূমির মাছ, সমুদ্রের সকল জীবের কল্যাণের বিষয়ও ভাবি। সৃষ্টিকর্তা এদেরও সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতিতে এদের একটি করে ভূমিকা দেওয়া আছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এদেরও দরকার আছে। এদের একটি যদি আমরা নিঃশেষ করে ফেলি তবে প্রকৃতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে ফলে মানুষের কষ্ট বাড়বে। বাড়িতে তাই খালি জায়গায় গাছ রোপণ ও নির্ধারিত গাছ  রক্ষণাবেক্ষণ জন্য ছেলেমেয়েদের  দায়িত্ব বন্টন করে দিতে পারি। শিশুদের চিত্রাঙ্কণ, সঙ্গীত ও নৃত্য চর্চায় প্রকৃতি ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়সমূহে উৎসাহিত করা যায়। গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা শহরে বাসাবাড়িতে টবে বারান্দায় বা ছাদে অথবা জানালার পাশে শাক-সবজি-ফুল বাগান তৈরি করি ও রক্ষণাবেক্ষণ করি। এতে মনে প্রশান্তি আসবে, স্বাস্থ্যকর খাবারের যোগান হবে এবং বাজার খরচ সঞ্চয় করতে পারব।

৪. কর্মস্থলে প্রয়োজন ছাড়া কাগজে প্রিন্ট না করা, প্রয়োজনে কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় প্রিন্ট করা এবং সুযোগ থাকলে কাগজ পুনঃব্যবহার করতে পারি; কম্পিউটার, প্রিন্টার ও অন্যান্য অফিস সরঞ্জামসমূহ ব্যবহারের পরে বন্ধ রাখব; শারীরিক সমস্যা ব্যতিত দ্বিতীয়, তৃতীয় তলায় এবং সকালে লিপ্ট ব্যবহারে বিরত থাকা; এবং দলীয়ভাবে গাড়ী ব্যবহার করার মাধ্যমে কার্বন ব্যবহার হ্রাস করতে পারি। একটি মানবিক পরিবেশ রক্ষার জন্য কর্মস্থলে নারীদের প্রতি আচার-আচরণে শিষ্টাচার অনুসরণ,  সহকর্মীদের প্রতি পারস্পরিক যত্নশীল থাকা, সৌজন্যসূচক শব্দ ব্যবহার, দলীয়করণ মনোভাব ও অযাচিত তোষামোদপ্রিয় স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। কর্মস্থলের খালি জায়গায় অথবা টবে বারান্দা বা ছাদে অথবা জানালার পাশে শাক-সবজি-ফুল বাগান তৈরি করি ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি।

৫. আফ্রিকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানুষ পানীয় জলে চরম সংকটে আছে, ভারতের  কোন কোন প্রদেশে অনেক দামে পানি কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে, পাহাড়ী অঞ্চল রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের বিশুদ্ধ পানির অভাবে ঝর্ণার পানি পান করে ছোট ছোট শিশুরা এখনও মারাত্বক রোগব্যাধিতে অসুস্থ হয়ে কষ্ট করছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণও করছে। তাদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা  স্নানে কম পানি ব্যবহার করতে পারি, হাতমুখ ধোয়ার সময় কলের পানি নষ্ট না করি, যতটুকু পান করতে চাই ততটুকু পানি  গ্লাসে ঢেলে পান করতে পারি। আমাদের এমন ক্ষুদ্র ক্ষ্রদ্র অভ্যাস পানি অপচয় অনেক হ্রাস করবে।

৬. মাটি একটি জীবন্ত উপাদান। জীবন মাটি থেকে আসে এবং তাই মাটি বাঁচিয়ে রাখা উচিত। একে মারা উচিত নয়।  স্বতন্ত্রভাবে মোড়ানো ক্যান্ডি প্লাস্টিক ব্যবহার করে থাকে এবং প্রচুর আবর্জনা তৈরি করে যা মাটিকে নষ্ট করে ফেলে। আমরা এ মুহূর্তে প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বাদ দিতে পারছি না। তাই সঠিকভাবে ব্যবহার করার দিকে গুরুত্ব দিতে পারি। আবর্জনা হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পলিথিন ব্যাগ একেবারেই বাদ দিতে হবে কারণ এর ক্ষতির ধরণ বহুমাত্রিক এবং বাড়ছে- মাটি নষ্ট করে জমিতে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করছে, শহরে নর্দমা বের হওয়ার পথ বন্ধ করে ব্যাপক ক্ষতি করছে এবং আগুনে দিলে গ্যাস হয়ে বায়ুদূষণ করে মানবদেহের সংঘাতিক ক্ষতি করছে। তাই পাটের তৈরি চটের ব্যাগ অথবা ভারী ও শক্ত কাপড় পুনঃব্যহার করে ব্যাগ তৈরি করে ব্যবহার করতে হবে।

৭. করোনাভাইরাস মহামারী শিখিয়েছে আমাদের আরও বেশি যতবান ও রক্ষণাবেক্ষণ মনোভাব প্রয়োজন। নিজের কল্যাণের কথা ভেবেই প্রকৃতি, পরিবেশ এবং প্রতিবেশীর সুরক্ষা সুসংবাদটি আপনজন, ও বন্ধুবান্ধবদের  জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র একটি আহ্বান। ইতোমধ্যে অনেকে নীরবে কাজ করে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছি। পোপ মহোদয়ের আহব্বান সাড়া দিয়ে আমাদের আবাসস্থল, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষার্থে ‘লাউদাতো সি বা তোমার প্রশংসা হোক সপ্তাহে’ ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে এবং কর্মস্থলভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ মহান কিছু অর্জন সম্ভব হবে।