পোপ ফ্রান্সিস : ইরাক সফর : শান্তির তীর্থযাত্রা
(মার্চ ৫–৮, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ)
কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি
পোপ ফ্রান্সিসের সফরের উদ্দেশ্য
বিগত মার্চ ৫-৮, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস ইরাক সফরে যান। অনেকদিনের প্রতীক্ষিত এই সফর। পোপ ফ্রান্সিসের জন্য এ সফরটি ছিল “শান্তির তীর্থযাত্রা”। উদ্দেশ্য ছিল শান্তি: ভালবাসা, ক্ষমা, একাত্মতা, সমবেদনা, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পুনর্মিলন ও শান্তি। সফরটি পথযাত্রা ছিল তীর্থযাত্রা : আধ্যাত্মিক, প্রায়শ্চিত্ত, অনুতাপ, মিলনের উদ্দেশ্যে যাত্রা, প্রাচীন সভ্যতার স্পর্শ, বাইবেলের পবিত্র ভূমি, ব্যক্তি, ঘটনার সাথে একাত্মতা, বহুধর্মের মানুষের সাথে, ভাল-মন্দ সকল মানুষের সাথে ঐক্য, মিলন ও ভ্রাতৃত্ব।
॥ ক ॥ ইরাকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ইরাক হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০)। এখানে গড়ে উঠেছে বিশ্বের প্রাচীন হস্তলিপি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, বিধানশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র। সেই জন্য ইরাক সাধারণতঃ প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি বলে অভিহিত। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর মধ্যভাগে, মেসোপটামিয়া নামে পরিচিত অঞ্চলে, গড়ে ওঠেছে সুমেরীয়, বাবিলনীয় এবং আশেরীয়দের প্রাচীন সাম্রাজ্য। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য, অনেক সংগ্রামের পরে বাগদাদকে এবং পারস্য অধিকার থেকে মেসোপটামিয়াকে ১৬৩০ খ্রি. দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইরাক বিট্রিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সাদ্দাম হোসেন ১৯৬৮ থেকে ২০০৩ খ্রি. রাজত্ব করেন যে-সময়ে ইরান-ইরাক ও গাল্ফ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২০০৩ খ্রি. যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী কর্তৃক ইরাক দখল করা হয়। পরবর্তীতে অনেক বছর গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে ইরাক দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়: ইরাক সরকার কর্তৃক পরিচালিত দক্ষিন ও কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল যা কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক এবং ইসলামিক রাষ্ট্র ইরাক এবং লেভান্ত (অর্থাৎ আই.এস.আই.এস) কর্তৃক পরিচালিত হয়। আই.এস ২০১৭ খ্রি. ইরাক থেকে বিতাড়িত হয় যদিও দুর্বৃত্ত হিসেবে কিছু কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে।
॥ খ ॥ ইরাক বাইবেলের ঘটনাবহুল দেশ
প্রথমবারের মতো একজন পোপ, পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এ বছর (২০২১ খ্রি) মার্চ ৫-৮ তারিখে ইরাকে এক ঐতিহাসিক সফর করে আসলেন। এই সফরটি তাঁর জন্য ছিল তীর্থযাত্রা স্বরূপ। বহুমাত্রিক ছিল ঐতিহাসিক তীর্থযাত্রাটি। এই তীর্থযাত্রা নিয়ে বিভিন্ন ভাবে আলোকপাত করা হবে। তবে এই অংশে তীর্থযাত্রার একটি দিক তুলে ধরছি। সহস্র বছর ধরে ইরাকের এলাকায় মানব সভ্যতার অনেক ঘটনা এবং বিশেষভাবে বাইবেলের অনেক ঘটনা সম্পন্ন হয়। বাইবেলের সেই ঘটনা, স্থান, ব্যক্তি, বাণীগুলি পবিত্র বলে আমরা যারা বিশ্বাসী আমাদের জন্য স্বীকৃত হয়ে আছে। এই দিক থেকে, কাথলিক মণ্ডলীর প্রধান, একজন পোপের তীর্থ আমাদের কাছে বাইবেলীয় ঘটনা আরও পরিচিত ও স্মরণীয় করে তুলেছে। নিম্নে বাইবেলের যে সমস্ত ঘটনা পুরনো ইরাকে ঘটেছে তার সংক্ষিপ্ত একটা তালিকা বাইবেলের নির্দেশিকাসহ তুলে ধরছি।
ইরাকেই স্থান পেয়েছে বাইবেলে উল্লেখিত বাইবেলের ঘটনাবলি : এদেন উদ্যান – আদিপুস্তক ২:১০; আদম ও হবার সৃষ্টি – আদিপুস্তক ২:৭-৮; পুরুষ ও নারীর নিকট শয়তানের (সাপ) প্রলোভন – আদি ৩:১-৬; সভ্যতার আদিভূমি, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর মধ্যবর্তী এলাকা মেসোপটামিয়া; নোয়ার নৌকা – আদি ৭:৫; বাবিলনে বাবেলের মিনার তৈরী – আদি ১১:৮-৯; ১১-১৪; বাবেল মিনার ঘিরে ভাষার বিভ্রান্তি – আদি ১১:৫-১১; র্উর নগরীতে আব্রাহামের আবির্ভাব – আদি ১১:৩১; ইসাহাকের স্ত্রী রেবেকা – আদি ২৪:৩-৪, ১০; যাকোব ও রাখেলের সাক্ষাৎ – আদি ২৯:১০; যাকোব ২০ বছর ইরাকে অবস্থান করেছেন – আদি ২৭:৪২-৪৫; আসিরিয়ার দখলে ইস্রায়েলের দশটি জাতিগোষ্ঠী – যোশুয়া ২২:১৪; রাণী এস্থার গ্রন্থের ঘটনাবলি – এস্থার গ্রন্থ; প্রবক্তা এজেকিয়েলের প্রচার – এজেকিয়েল গ্রন্থ; প্রথম বিশ্ব সাম্রাজ্য ইরাক – দানিয়েল ১:১-২; ২:৩৬-৩৮; শাদ্রাক, মেশাক ও আবেদনেগো এই তিন হিব্রু সন্তানের শহীদ মৃত্যু – দানিয়েল ৩:২১; বাবিলন রাজা কর্তৃক “প্রাচীরের গায়ে লেখা” দর্শন – দানিয়েল ৫:৫; সিংহের মাঝে দানিয়েল – দানিয়েল ৬:১৬; প্রবক্তা আমোসের প্রচার – আমোস গ্রন্থ; ইরাকের ইতিহাসে নবজাগরণ (মাছের পেটে যোনা) – যোনা ৩; নিনিভে যোনার প্রচার – যোনা গ্রন্থ; বাবিলন নগরীর ধ্বংস সম্বন্ধে নাহুমের ভবিষ্যদ্বাণী – নাহুম গ্রন্থ; ইরাকের বাবিলন জেরুসালেমকে ধ্বংস করে – এজরা ৫:১২; বাবিলন রাজা নেবুকাদনেজার ইস্রায়েলদেরকে ইরাকে নির্বাসনে নিয়ে যান – এজরা ৫:১২; ইরাক থেকে নবজাত যীশুকে দেখতে তিন পণ্ডিতের আগমন – মথি ২:১; ইরাকে পিতরের প্রচার – ১ পিতর ৫:১৩; ইরাকের একটি নগরীতে প্রত্যাদেশ গ্রন্থে বর্ণিত “মানুষের সাম্রাজ্য” বাবিলনের উল্লেখ – প্রত্যাদেশ ১৭ এবং ১৮; ইরাকেই ইস্রায়েলদের সবচাইতে বেশি ইতিহাস ও ভবিষ্যদ্বানী স্থান পেয়েছে।
॥ গ ॥ তীর্থের বিশিষ্ট স্থান, ব্যক্তি ও জনগণসমূহ
(১) সিরিয়ান-কাথলিক সায়েদাট-নাজাত কাথিড্রালে পোপের প্রার্থনা (৫ই মার্চ, ২০২১)
ঐতিহাসিক সফরের প্রথম দিনে পোপ ফ্রান্সিস সিরিয়ান-কাথলিক সায়েদাট-নাজাত কাথিড্রালে প্রার্থনা করেন। এখানে তিনি স্মরণ করেন যে, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে, খ্রিষ্টযাগ চলাকালে আই.এস গির্জাটি আক্রমণ করে। দুজন পুরোহিত সহ ৪৮জন কাথলিককে হত্যা করা হয়। শহীদদের ছবির নিচে বসে পোপ মহোদয় ইরাকী কাথলিকদের নিকট আবেদন জানিয়ে বলেন যে, “নিরাশার ভাইরাস” যেন তোমাদের মধ্যে সংক্রামিত না হয়। নির্যাতনের সময় তারা যেন তাদের “প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত বিশ্বাসের শেকড় থেকে এবং এই মাটিতে ম-লীর নিরবিচ্ছিন্ন উপস্থিতির বিশ্বাস দ্বারা সংক্রামিত হয়ে বাস করে।”
পোপ মহোদয় গভীর সমবেদনা নিয়ে উপলব্ধি করছেন যে, “ইরাকী ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতিদিনের দুর্যোগ তাদের বর্তমান অভিজ্ঞতা”। তিনি পরামর্শ দেন যেন বিভিন্ন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য থাকে এবং “আত্ম-কেন্দ্রীকতা ও প্রতিযোগিতা” সর্বদা পরিত্যাগ করে।
(২) আব্রাহামের পদচিহ্নে পোপের পদচারণা (৬ই মার্চ, ২০২১)
আমরা ভাবি যে, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের মধ্যে যে বাধা আছে তা কোন দিনও জয় করা যাবে না। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস ইরাকে সফর করে ভিন্নতর একটা সুযোগ উন্মুক্ত করলেন।
পোপ ষষ্ঠ পল ও পোপ দ্বিতীয় জন পল, আজ তারা দু’জনেই সাধু, তারা বাসনা করেছিলেন এমন কি ২০০০ মহান জুবিলীতে সেখানে যেতে না পেরে দ্বিতীয় জন পল নিজে কেঁদেছিলেন, আজ সেখানেই পোপ ফ্রান্সিস, র্উর নামক মুক্ত প্রান্তরে তীর্থযাত্রী রূপে পদার্পণ করলেন। “ মুসলিম, ইহুদী ও খ্রিষ্টান পরিবারের পিতা আব্রাহামের পদচিহ্নে”পোপ ফ্রান্সিস পদচারণা করলেন। ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে কোন শত্রু নেই।
সেখান থেকে পোপ ফ্রান্সিস বললেন: “পিতা আব্রাহাম, সকল হতাশার মধ্যে আশা রেখেছিলেন, আর তিনি আমাদেরকে উৎসাহিত করেছিলেন।”
(৩) র্উর সমতল প্রান্তরে পোপের আন্তঃধর্মীয় সমাবেশ, ৬ই মার্চ
শনিবার ৬ই মার্চ, পোপ মহোদয় র্উর নামক সমতল প্রান্তরে সমবেত হলেন। র্উর প্রান্তরেই ছিল পিতা আব্রাহামের বাড়ী। পোপ বললেন: “এখানেই আমাদের পিতা বাস করতেন, আমরা যেন পিতার বাড়ীতে ফিরে এসেছি”। শুধু পোপের বাড়ী নয়, সফর-সঙ্গী হয়ে খ্রিষ্টান ও মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের নেতৃবৃন্দদের প্রতিনিধি যারা ছিলেন তাদেরও এই বাড়ী। মানবজাতির প্রাচীন সভ্যতার সুত্রপাত এখান থেকেই।
“আমরা যদি ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করতে চাই, তাহলে স্বর্গের দিকে আমাদের তাকাতে হবে। আমরা যারা আব্রাহামের বংশধর এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছি, আমরা যেন বুঝতে পারি যে, আমাদের একটা ভূমিকা আছে: আমাদের ভাইবোনদেরকে সাহায্য করা, যেন তারা দৃষ্টি উত্তোলন করতে পারে এবং স্বর্গের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতে পারেন”, পোপ মহোদয় বলেন।
পোপ আরও বলেন: “এখান থেকেই, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল, আমরা আমাদের বিশ্বাস দৃঢ় করি যে, ঈশ্বর দয়াময় এবং সবচাইতে ঘৃণ্য ঈশ্বর-নিন্দা হচ্ছে আমাদের ভাইবোনদের ঘৃণা করা ও তাঁর পবিত্র নামের অবমাননা করা।
(৪) গ্রাণ্ড ইমাম আয়াতুল্লাহ্ আলি আল–সিস্তানি–এর সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিসের সাক্ষাৎ (নাজাফ, মার্চ ৬)
গ্রাণ্ড আয়াতুল্লাহ্ আলি আল-সিস্তানি, যিনি শিয়া মুসলমানদের সর্বপ্রধান ধর্মনেতা, তাঁর সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিস সাক্ষাৎ করেন। যদিও তাদের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা ছিল ৩০ মিনিটের জন্য, কিন্তু তাদের সংলাপ ৫০ মিনিট ধরে চলে। এই সাক্ষাৎটি ছিল ঐতিহাসিক ও নিদর্শন স্বরূপ, কেননা গ্রাণ্ড আয়াতুল্লা ছিলেন মুসলমান শিয়া সম্প্রদায়ের সর্বপ্রধান নেতা। পোপ ফ্রান্সিসের বয়স ৮৪ এবং আয়াতুল্লাহ্ সিসতানির বয়স ৯০ বছর। দুই প্রধান ধর্মনেতাদের মধ্যে এই সংলাপ বিশ্বের কাছে খুবই গুরত্বপূর্ণ।
তাঁদের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল: মানবসমাজের বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের (আল্লাহ্র) প্রতি বিশ্বাসের ভূমিকা, ঈশ্বরের (আল্লাহ্র) বার্তা, এবং প্রধান প্রধান নৈতিক মূল্যবোধ যা ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী জীবনযাপন করতে সহায়তা করবে।
গ্রাণ্ড আয়াতুল্লাহ্, যিনি ইরাকের শিয়া সম্প্রদায়ের খুবই শ্রদ্ধাভাজন ও অনুকরণীয় ব্যক্তি, তিনি বিশেষ করে যে-বিষয়ে কথা বলেছেন তাহল: “অন্যায়, নিপীড়ন, দারিদ্র, ধর্মীয় ও যুক্তিবাদি নির্যাতন, মৌলিক স্বাধীনতার অবমাননা, সামাজিক ন্যায্যতার অভাব, বিশেষ করে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সহিংসাত্মক কর্মকা- এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।” তিনি ইস্রায়েলের দখলাধীন প্যালেস্টাইন জনগণের অবস্থা উল্লেখ করেন। গ্রাণ্ড আয়াতুল্লাহ্ দৃঢ়ভাবে বলেন যে, “বড়ো বড়ো ধর্মগুলি ও তাদের ধর্মনেতাদের ভূমিকা হল সকল প্রকার দুঃখজনক ঘটনার মূল উৎস উৎপাটন করা, সংশ্লিষ্ট পক্ষ, যারা বিশ্বের ক্ষমতাধর জাতি, তাদেরকে বলেন যেন তারা যুক্তি ও প্রজ্ঞার উপর গুরুত্ব দেয় এবং যুদ্ধের ভাষা ত্যাগ করে।”
গ্রাণ্ড আয়াতুল্লাহ্ দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেন যে, তিনি “প্রতিবেশী খ্রিষ্টানদের পক্ষে আছেন”, “সকল ইরাকীদের সঙ্গে” তারাও তাদের “সাংবিধানিক অধিকারের কারণে নিরাপত্তা ও শান্তির অধিকার তাদের আছে।” যারা “আই.এস”-এর হাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে “অন্যায় ও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে” তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। সংলাপের মাধ্যমে ইরাককে পুনর্গঠন করতে হবে।
ভাতিকানের পুণ্য দপ্তর পোপ ফ্রান্সিস ও আয়াতুল্লাহ আল-সিসতানির মধ্যে আলোচনার বিবৃতিতে বলেছেন যে, “পুণ্যপিতা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের উপর, যাতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংলাপের মাধ্যমে, ইরাক, মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চল এবং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য সবাই অবদান রাখতে পারে।” তিনি বলেন যে, “এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে পোপের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে তিনি গ্রাণ্ড আয়াতুল্লাহ্ আল-সিসতানি-কে ধন্যবাদ দিতে পারছেন, কারণ তিনি, গোটা শিয়া সমাজের হয়ে, ইদানিং সহিংসতার মধ্যে এবং নানা সঙ্কটে বিপর্যস্ত হয়ে, যারা নির্যাতিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে তাদের পক্ষে তিনি কথা বলেছেন, এবং মানবজীবনের পবিত্রতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং ইরাকের সকল জনগণের মধ্যে ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন।”
এখন বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে এই ধর্মনেতাদের সাক্ষাৎ ও আলোচনার ফলাফলা কী হবে? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া এখনও সম্ভব নয়, তথাপি অনেকেই আশা করেন যে, পোপ ফ্রান্সিস ও আয়াতুল্লাহ্ হয়তো একদিন মানব ভ্রাতৃত্বের পক্ষে যৌথভাবে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, সে ধরনের একটি চুক্তি, সুন্নি মুসলমানদের প্রতিনিধি, কায়রো আল-আজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাণ্ড ইমামের সাথে ২০১৯ খ্রি. ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখে, আবুধাবি-তে সাক্ষরিত হয়েছে।
(৫) কারাকোশ-এর জনগণের সাথে পোপের সাক্ষাত (৭ই মার্চ, ২০২১)
তিনি যখন কারাকোশে হেলিকপ্টার থেকে নেমে গাড়ীতে যাচ্ছিলেন, তখন হাজার হাজার মানুষ ছুটাছুটি করে তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তারা ছিল সেই জনগণ যাদেরকে আই.এস. ২০১৪ খ্রিষ্টাব্ধে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল, কেননা তারা ছিল খ্রিষ্টান। এদের মধ্যে আছে সেই জনগণ যারা সবকিছু ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এদের মধ্যে আছে তারা, যারা অনেক সাহস নিয়ে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে আই.এস. বিতাড়িত হওয়ার পর আবার ফিরে এসেছে।
পোপ মহোদয় এসেছেন তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে ও তাদের উৎসাহ দান করতে। তিনি বললেন: “তোমরা একা নও”, গোটা মণ্ডলী তোমাদের সাথে আছে।” অনেক ভালবাসা ও বলিষ্ঠতা নিয়ে পোপ মহোদয় আবেদন জানিয়েছেন যেন তারা ইরাক ছেড়ে চলে না যায়। শতকরা ৪০% যারা ফিরে এসেছে তাদেরকে পোপ বললেন: “এখনই তো নির্মাণ ও নতুন করে শুরু করার সময়”।
সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থেকে যারা রক্ষা পেয়েছেন তাদেরকে পোপ মহোদয় অনেক সাহসিকতার সাথে বললেন: “ক্ষমা কর”; যারা তোমাদের শেষ করে দিতে চেয়েছিল তাদেরকে তোমরা “ক্ষমা কর; ভালবাসায় থাকতে হলে, খ্রিষ্টান হতে হলে ক্ষমা একান্ত প্রয়োজন”। কারকোশের জনগণকে অনুযোগ করে বললেন: “পুনরুদ্ধারের পথ হয়তো এখও লম্বা, তবে আমি অনুরোধ করি, দয়া করে, তোমরা হতাশ হয়ো না।” তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, এই আবেদন মানবিক দিক দিয়ে হয়তো অযৌক্তিক হতে পারে।
(৬) মসুল-এর ধ্বংসাবশেষে পোপের সমাবেশ
মসুল ছিল তিন বছর ধরে আই.এস-এর শক্তিশালী ঘাটি। ওখানে পোপ মহোদয় ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লিতানির মতো নিন্দা জানিয়েছেন।
মসুল ধ্বংসাবশের উপর দাঁড়িয়ে পোপ মহোদয় একদিকে সকল সহিংসতার নিন্দা করেছেন, আবার অন্যদিকে ক্ষমার বাণী শুনিয়েছেন: “ঈশ্বর যদি জীবনময় ঈশ্বরই হন, আর তিনি সত্যিই তাই, তাহলে তার নামে আমাদের ভাইবোনদের হত্যা করা অন্যায়। ঈশ্বর যদি শান্তিময় ঈশ্বরই হন, আর তিনি সত্যিই তাই, তাহলে তার নামে যুদ্ধ করা অন্যায়। ঈশ্বর যদি প্রেমময় ঈশ্বরই হন, আর তিনি সত্যিই তাই, তাহলে আমাদের ভাইবোনদের ঘৃণা করা অন্যায়।”
(৭) এরবিল স্টেডিয়ামে রবিবারের খ্রিষ্টযাগ, ৭ই মার্চ
এরবিল স্টেডিয়ামে রবিবারের খ্রিষ্টযাগ ছিল পোপের ইরাক সফরের সর্বশেষ কর্মসূচী। এখানে দশ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। বিদায়ী খ্রিষ্টযাগে পোপ ফ্রান্সিস বলেন: “এই ইরাকে, আমাদের কত হাজার ভাইবোন, আমাদের বন্ধু ও সহ-নাগরিক যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের কারনে ক্ষত বহন করে যাচ্ছে, কোন কোন ক্ষত দৃশ্যমান আবার কোনটি অদৃশ্য। এই ধরনের বা হৃদয়-বিদারক অন্যান্য অভিজ্ঞতার ফলে, প্রলোভন আসে মানুষের ক্ষমতা ও জ্ঞান দ্বারা তার বিরোধিতা করা। কিন্তু যীশু আমাদেরকে ঈশ্বরের পথ দেখান। আজ ইরাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি ইরাকের ম-লী জীবন্ত, পবিত্র ও খ্রিষ্টবিশ্বাসী ভক্তদের মধ্যে খ্রিষ্ট জীবিত ও সক্রিয়। ইরাক আমার মধ্যে সর্বদা থাকবে।” আর পোপ নিশ্চিত যে, এই “প্রিয় দেশটি” তাঁকেও শীঘ্র ভুলে যাবে না।
॥ ঘ ॥ তীর্থের কতিপয় উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ
(১) বীজ বপন: শ্রদ্ধা, একতা ও আশা
পোপ ফ্রান্সিস, তার ইরাক সফরের মধ্য দিয়ে ইরাকের জন্য তিনটি বীজ বপন করে গেছেন: শ্রদ্ধা, একতা ও আশা। তার ঐতিহাসিক সফর যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগণের কাছে সার্বভৌমত্ব, শান্তি ও ঐকের বিজয় ঘোষণা করেছে।
পোপ মহোদয় প্রথম যে বীজ বপন করেছেন তাহল: ইরাকের আত্মসম্মান। তাই তিনি বলেছেন ইরাকের সার্বভৌমত্ব “পদদলিত করা থেকে বিরত থাক! বিশ্বের ক্ষমতাশালী দেশগুলির জন্য খেলার মাঠ হিসেবে, ইচ্ছামতো ব্যবহার করা থেকে আসুন আমরা বিরত থাকি।” এই প্রথম পদক্ষেপ একান্ত অপরিহার্য।
দ্বিতীয় বীজ হচ্ছে: একতা। ইরাকে একতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি, ধর্মবিশ্বাসী ও নাগরিককে স্বীকৃতি দান করবে, তাদের অধিকার স্বীকার করবে।
তৃতীয় বীজ হচ্ছে: আশা। একতা সবার জন্য পথ করে দেবে যেন ভবিষ্যতে তার আশা নিয়ে পথ চলতে পারে। আশান্বিত হয়ে ইরাকের জনগণ যেন দেশ, সমাজ ও ধর্মসম্প্রদায়গুলিকে পুনঃনির্মিত করতে পারে।
(২) আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক ও সংলাপের নতুন দিগন্ত
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের জন্য প্রচলিত কয়েক প্রকার সংলাপ আছে যার সম্বন্ধে আমরা কমবেশি সবাই অবগত আছি। সেই সংলাপের রকমগুলি হচ্ছে: জীবন-ভিত্তিক সংলাপ, কর্মকা- বা কার্যক্রম ভিত্তিক সংলাপ, আলোচনা ভিত্তিক সংলাপ এবং আধ্যাত্মিক সংলাপ।
তবে পোপ ফ্রান্সিস কয়েক বছর ধরে তাঁর শিক্ষায় আরেক ধরনের সংলাপের অবতারণা করে যাচ্ছেন। আর তার সুফল বিশ্বব্যাপী পরিলক্ষিত হচ্ছে। শান্তির তীর্থযাত্রী হিসেবে বহুধর্মবিশিষ্ট দেশে যাত্রা করা এবং প্রধান ধর্মনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ইরাকে পোপ ফ্রান্সিসের বিগত সফরটি আন্তঃধর্মীয় সংলাপের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এই তীর্থযাত্রা এবং ধর্মনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ সরাসরী বা প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয় না। তবে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ছাড়া উক্ত সংলাপ করাও সম্ভব হবে না। আলোচ্য বিষয়গুলি অনেকটা মানবতা ভিত্তিক। পোপ মহোদয়ের জন্য এক কথায় “মানব ভ্রাতৃত্ব”ই হচ্ছে মূল বিষয়।
ইদানিং যে বিশ্বজনীন পত্রগুলি পোপ ফ্রান্সিস প্রকাশ করেছেন তার মধ্যে “মানব ভ্রাতৃত্ব”, মানব পরিবারে আমরা সবাই ভাইবোন, মানবব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার, ন্যায় ও শান্তি, নাগরিক অধিকার, আত্মপরিচয়, রাজনীতি, ধর্মের ভূমিকা, ইত্যাদি বিষয়গুলি স্থান পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বজনীন পত্রগুলি হচ্ছে: “লাউদাতো সি”, “ফ্রাতেল্লি তুত্তি” উল্লেখযোগ্য।
উপরোক্ত ধ্যান-ধারণার উপন ভিত্তি করে পোপ মহোদয় ও ধর্মনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সমাপ্তিতে চুক্তিও সাক্ষরিত হচ্ছে বা চুক্তি করার পথে প্রচেষ্টা চলছে। এখানে উল্লেখ্য ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আবুধাবিতে কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের গ্রাণ্ড ইমাম আল-তাইয়েব (সুন্নী মুসলমান সম্প্রদায়ের ইমাম)-এর সঙ্গে “বিশ্বশান্তি ও সমাবেত জীবনের জন্য মানব-ভ্রাতৃত্ব” শীর্ষক সম্পাদিত চুক্তি। ইরাকের শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের গ্রাণ্ড ইমাম আয়াতুল্লাহ্ আলি আল-সিসতানির সঙ্গে পোপের সাক্ষাৎ ( ৬ মার্চ ২০২১ খ্রি.) এবং আলোচনার বিষয়বস্তু বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, হয়তো একদিন পারস্পরিক সমঝোতায় যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। এই পদক্ষেপগুলি মনে হচ্ছে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক ও সংলাপের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত, দৃষ্টান্ত ও ভবিষ্যতে মাইলফলক হয়ে কাজ করবে।
(৩) পোপ ফ্রান্সিসের নিজস্ব সাক্ষ্যবাণী
পোপ নিজে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন: “আগে কোন পোপ আব্রাহামের ভূমিতে যেতে পারেন নি। বিধাতা চেয়েছেন যে, এখন সময় হয়েছে। বহু বছরের যুদ্ধ ও সহিংসতার পর, বৈশ্বিক মহামারি কালে সফরটি ছিল একটি আশার চিহ্ন।” তিনি আরও বলেন: “এই তীর্থযাত্রায় আমি উপলব্ধি করেছি একটি অনুতাপের ভাব। নির্যাতিত জনগণের কাছে, শহীদ-মণ্ডলীর কাছে যেতে পারছিলাম না, যদি না আমি, কাথলিক মণ্ডলীর নামে, আমার নিজের কাঁধে সেই ক্রুশটা বহন না করি, যে ক্রুশ তারা বছরের পর বছর বহন করে আসছে; খুবই বিশাল সেই ক্রুশ!” এই সত্য তিনি উপলব্ধি করেছেন যখন তিনি দেখেছেন ধ্বংসের তাজা ক্ষত; তার চাইতেও বেশি, যখন তিনি তাদের মুখ থেকে সহিংসতা ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি লাভের কথা ও সাক্ষ্য শুনেছেন।
পোপ বলেন, “যুদ্ধের প্রতিবাদে যুদ্ধ নয়, অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র নয়; কিন্তু আমাদের আহ্বান ভ্রাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা, যা শুধু ইরাকের জন্য নয় বরং আরও বহু অঞ্চল এবং গোটা বিশ্বের জন্য গ্রহণ করা, যেখানে নানা দ্বন্দ্ব এখনও চলছে।”
“শান্তিতে বসবাস করা এবং নিজস্ব মর্যাদা আবিষ্কার করার অধিকার ইরাকী জনগণের আছে” তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন যে, “ঈশ্বর তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বিশ্বস্ত। আজও তিনি আমাদেরকে শান্তির পথে চলতে সাহায্য করেন। এই জগতে যারা স্বর্গপানে তাকিয়ে শন্তির পথে যাত্রার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাদেরকে তিনি পরিচালনা দান করেন।”
তিনি এ বলেন যে, “সুতরাং আমাদের পথ হল ভ্রাতৃত্বের পথ, ঢাক-ঢোল না পিটিয়ে ফলপ্রসূ যাত্রা করা, যা আমাদেরকে ক্রমশঃ উন্নতির পথেই নিয়ে যাবে।”
পোপ মহোদয় পরিশেষে বললেন যে, ইরাক তীর্থযাত্রায় আমি উপলব্ধি করেছি “খ্রিষ্টের বার্তা গ্রহণ করার আনন্দ” এবং ইরাকী জনগণ “আশা নিয়ে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের নবদিগন্তের পথে চলতে উম্মুক্ত”।
তথ্যপঞ্জী
- Internet: Wikipeadia
- Youtube, Biblical Iraq
- Own Staf, La Croix International, 5th March, 2021
- Paul Moses, La Croix International, March 6, 2021
- Isabelle de Gaulmyn La Croix International, 6th March, 2021
- Loup Besmond de Senneville La Croix International, 7th March, 2021
- Own Staff, La Croix International, 7th March, 2021
- Msgr Pascal Gollnisch, La Croix International, March 8, 2021