গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দের দুপুর ১:২০ মিনিটে আমেরিকার ইণ্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত নটরডেম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলার অকৃত্রিম বন্ধু হলিক্রস ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টীম, সিএসসি। আমেরিকার ইণ্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের মিশিগান সিটিতে জন্মগ্রহণকারী টীমের জন্ম ২ মার্চ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ৬ জুন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি’র বিখ্যাত কাথলিক ইউনির্ভাসিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর সাসে যুবক ফাদার টীম বাংলাদেশে আসেন মিশনারী কাজ করতে। কাজের শুরুতেই সম্পৃক্ত হন ঢাকার বিখ্যাত নটরডেম কলেজের সাথে। কলেজে যুক্ত করেন বিজ্ঞান বিভাগ। সহ-কার্যক্রম হিসেবে শুরু করেন বিতর্ক ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব ইত্যাদি। দেশের ক্রান্তিকালে ১৯৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে ফাদার টীম নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন।
মার্কিনী হলেও ফাদার টীমের বাংলাদেশ প্রীতি সবাইকে মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের প্রতি তার ভালবাসা অপরিসীম। বাংলার গরীব-দুঃখী ও অভাবীদের পাশে থাকতে তিনি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পরে, ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুর্নগঠনে এবং ১৯৮৮ ও ৯৮ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ বন্যার পরে তিনি নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কারিতাসের আঞ্চলিক অফিসকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মানব সেবায়। মনপুরা চরের মানুষের জীবনযাত্রা তাকে বদলে দেয়। এবার বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী রিচার্ড টীম বাংলার দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের কাজে ব্রতী হন। তাই কারিতাসের সাথে যুক্ত হন ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে। এছাড়াও মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষার কাজেও সহায়তা দান করেন। মানবাধিকার চর্চা করে ন্যায্যতা ও শান্তি আনয়ন করতে তিনি হটলাইন বাংলাদেশের মাধ্যমে বিশেষ সহায়তা দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ফাদার রিচার্ড টীম তার লেখনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মতামত দেন এবং গণহত্যার বিরোধিতা করেন। গোপনে পাকবাহিনীর নৃশংসতার খবর সংগ্রহ করে ওয়াশিংটনে পাঠান এবং এর বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে নেপথ্যের কারিগরের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক প্রদান করে। সমাজ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে লাভ করেন এশিয়ার নোভেল খ্যাত র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার এবং সামাজিক ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষা করায় একই বছরে লাভ করেন আবু সায়েদ পুরস্কার।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জীববিজ্ঞানী হলেও ফাদার টীম ছিলেন বিশ্বস্ত ও আদর্শ এক যাজক। যিনি যিশুর ন্যায় ভালবাসাকেই তার জীবনে প্রথম স্থানে রেখেছেন। তাইতো বাংলার মানুষকে ভালবেসে ৭১ বছর যাবৎ বাংলাদেশ মণ্ডলীকে সেবা করে গেছেন। তার সমস্ত কাজ সমাপ্ত হলে ফাদার টীম ৯৭ বছর ৬ মাস বয়সে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করেন। অতীব জ্ঞানী ও বিনয়ী, সহজ-সরল ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টীম, সিএসসি অনেকেরই অনুপ্রেরণা। লৌকিকভাবে তিনি চলে গেলেও তিনি বেঁচে আছেন বাংলার শত সহস্র মানুষের হৃদয়ে।
ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টীম; বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ মণ্ডলী তোমায় ভালোবাসে। সেই ভালোবাসাতেই তুমি জীবন্ত থাকবে অবিরত।