জ্যাষ্টিন গোমেজ : ‘এই ধরণের আয়োজন আরো বেশি হওয়া দরকার’; ‘বাণীদীপ্তিকে ধন্যবাদ শিল্পীদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দেবার জন্য’; ‘শিল্পীদের কিছুটা মূল্যায়ন হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে’ .. এই ধরণের অভিব্যক্তি দিয়েই বিভিন্নজন তাদের ভাব প্রকাশ করছেন ‘সত্য-সুন্দর প্রকাশে শিল্পীরা সব একসাথে’ বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে শিল্পীসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ খ্রিস্টাব্দ রোজ শনিবার বিকাল ৪:৪৫ মিনিটে রমনা আর্চবিশপ হাউসে, বড়দিন ও পুনরুত্থান অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিটিভি’র বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ ও বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন কারিতাস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন ফ্রান্সিস রোজারিও, ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা, সেন্ট জন ভিয়ানী হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক ফাদার কমল কোড়াইয়া। এছাড়াও সম্মানিত অতিথিবৃন্দের মধ্যে ছিলেন বিটিভির নাট্য নির্দেশক মাসুদ চৌধুরি, বাণীদীপ্তির কণ্ঠশিল্পী পলিন ফ্রান্সিস ও হলিক্রস কলেজের প্রাক্তন প্রফেসর।
অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে থাকে খ্রিস্টীয় সঙ্গীত জগতের আলোকিত ব্যক্তিত্ব বাণীদীপ্তির শিল্পী প্রয়াত নিপু গাঙ্গুলী ও প্রয়াত জোসেফ কমল রড্রিক্স এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। এই পর্বে প্রয়াত শিল্পীদ্বয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকলেই এতে অংশ নেয়। তারপর বাণীদীপ্তির পরিচালক ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু শিল্পীদের আত্মার কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা পরিচালনা করেন । প্রার্থনা পর্বের পর প্রয়াত নিপু গাঙ্গুলী ও প্রয়াত জোসেফ কমল রড্রিক্স এর উপর নির্মিত একটি ডক্যুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এরপর স্মৃতিচারণ পর্বে পলিন ফ্রান্সিস বলেন, কমলের সাথে ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা। পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রায় সময়ই এগিয়ে এসেছি আমরা। এই শিল্পীদ্বয়ের মধ্যে দেখেছি অন্যদের সাহায্য করার অকৃত্রিম প্রচেষ্টা ও অন্যকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ। পংকজ গমেজ বলেন, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল চর্চা দেখেছি গাঙ্গুলী পরিবারে। তাই নিপুদার জীবনেও দেখেছি সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের ছাপ। এছাড়াও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে সহভাগিতা রাখেন জেরাল্ড রড্রিক্স ও পিউস গাঙ্গুলী।
এরপর শুরু হয় অনুষ্ঠানের পরবর্তী পর্ব। আর এই পর্বের শুরুতে খ্রীষ্টীয় যোগযোগ কেন্দ্রের পরিচালক পরিচয় পর্ব পরিচালনা করেন। তিনি বিভিন্ন ভাগে (যেমন গায়ক, নৃত্য-সঙ্গীত শিল্পী, অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক, নাট্যকার প্রভৃতি) শিল্পী ও কলাকুশলীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানান। এরমধ্য দিয়ে একজন আরেকজনকে চিনতে ও জানতে পারে। তারপর থাকে মূল্যয়ন পর্ব। এই মূল্যয়ন পর্বে বক্তব্য রাখেন ফাদার কমল কোড়াইয়। তিনি বিটিভিতে বাণীদীপ্তির অনুষ্ঠানের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরার পর বলেন, বড়দিন ও পুনরুত্থান অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের মান দিন দিন বাড়ছে ও শিল্পীদের সৃজনশীলতাও ফুটে উঠছে সুন্দরভাবে। আমি সকলের শুভ কামনা করি। তবে আরো নতুন নতুন নাট্যকার বেরিয়ে আসা দরকার। এরপর থাকে মুক্ত আলোচনা। এতে অংশগ্রহণ করেন উল্লাস গমেজ, জয় গমেজ ও বেবী রোজারিও। তারা পেশাদারিত্ব, নতুনত্ব, শিল্পীদের সম্মান-সম্মানী ও যথার্থভাবে নৃত্য পরিবেশন করার কথা বলেন। নৃত্য দিয়ে কিভাবে খ্রিস্টীয় বার্তা দেওয়া যায় তারজন্য প্রশিক্ষণের কথাও ওঠে আসে।
‘টেলিভিশনে আমাদের (খ্রিস্টানদের) অংশগ্রহণ’ বিষয়ের উপর বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করেন খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিচালক, ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু। তিনি বিটিভিকে ধন্যবাদ দেন, খ্রিস্টানদেরকে বিটিভিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেবার জন্য। বিশেষভাবে বড়দিন ও পুনরুত্থানে দু’টি অনুষ্ঠান করতে দিয়ে। যেখানে অনেক নতুন শিল্পী প্রতিবছর অংশ নিয়ে থাকে। সঙ্গতকারণেই অনুষ্ঠানের মান অন্যান্য কমার্শিয়াল অনুষ্ঠানের মতো হয় না। তবে যেসকল শিল্পীরা আছেন তারা অধিকাংশই দক্ষ শিল্পী না হওয়া সত্ত্বেও তাদের নিয়ে টেলিভিশনে অংশগ্রহণ করে যথেষ্ট খুশি। কেননা তারা তাদের একাগ্র প্রচেষ্টা ও সৃজনশীলতার সাথে ভাল অভিনয় করে যাচ্ছেন। আশা করব ধীরে ধীরে তারা দক্ষ ও আরো ভাল সৃজনশীল হবে। বিটিভি’র মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আরো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান করতে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তিনি শিল্পীদেরকে আহ্বান করেন। আর যারা ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে জাতীয় পর্যায়ের সাথে সংয্ক্তু আছেন তারাও বাণীদীপ্তিকে সাহায্য সহযোগিতা করবেন বলে প্রত্যাশা করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যে টেলিভিশনেই কাজ করি না কেন, আমাদের সকলের লক্ষ্য থাকা উচিত অনুষ্ঠানের মূল বিষয় যেন খ্রিস্টীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিরোধী না হয়।
বিশেষ অতিথিদের বক্তব্যে ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা বলেন, শিল্পীরা সবসময়ই সম্মানের। তবে সেই সম্মানটা যথার্থভাবে প্রকাশ পায় না। আজকে খ্রিস্টান সমাজের অনেক শিল্পীকে একসাথে দেখে বেশ ভালো লাগছে। একজন শিল্পী হাজারো মানুষকে আলোকিত করে। অনেক শিল্পী একসাথে অনেক বেশি আলো ছড়াতে পারবে। আমাদেরকে নতুন নতুন শিল্পী খুঁজে বের করতে হবে। বাণীদীপ্তি অনেক আগে থেকেই নতুন নতুন শিল্পী অন্বেষণে নিয়োজিত আছে। ঢাকা ক্রেডিটও শিল্পীদের নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ মণ্ডলীর জন্য আমরা একসাথে কাজ করে খ্রিস্টবাণী প্রচারে পথ চলতে পারবো বলে মনে করি।
কারিতাস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন ফ্রান্সিস রোজারিও বলেন, আমাদের খ্রিস্টান শিল্পীরা বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তাদের প্রতিভা দ্বারা খ্রিস্টের বাণী প্রচার করছেন তা সত্যিই অসাধারণ। আর আগের তুলনায় শিল্পীরা নিজেদের অবস্থান দিন দিন সমৃদ্ধ করছে তা বোঝা যাচ্ছে। বাংলাদেশ মণ্ডলী সার্বিকভাবে খ্রিস্টভক্তদের কথা চিন্তা করে। তাই সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের মাধ্যমে লেখক ও শিল্পীদের সাথে একাত্ম হয়ে বাণীপ্রচার করছে। আশির দশকে শিল্পীদের দেখে আনন্দে আমোদিত হতাম এখনও হই। তবে কখনো-কখনো পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আমাদেরকে শংকিত করে। আশা করি ভাল ও সৃজনশীল কাজে আমরা একজন আরেকজনকে সমর্থন, সম্মান ও সহযোগিতা করবো। কারিতাস বাংলাদেশ বাণীদীপ্তি ও যোগাযোগ কমিশনের সাথে বিভিন্নভাবেই জড়িত আছে এবং থাকবে। বিশেষভাবে শিল্পীদের মঙ্গলের জন্য তারা পাশে থাকবে যাতে করে শিল্পীদের মাধ্যমে খ্রিস্টের বাণী প্রচার আরো প্রসারিত হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ বলেন, সত্য-সুন্দর প্রকাশে শিল্পীরা সব একসাথে মূলবিষয়টি সুন্দর। আর এটা হওয়াই যথার্থ। আমরা যেন আমাদের সৃজনশীলতায় সর্বদা সত্য-সুন্দর প্রকাশে প্রস্তুত থাকি। জগতে সুন্দরের নামে অনেক বেশি নোংরামি ও অসত্য প্রকাশ হচ্ছে। আমাদের খ্রিস্টানদের সত্য-সুন্দরের উৎস যিশু। যাকে আমরা বিশ্বাস করি। সত্য-সুন্দরের পথে চলা কষ্টকর হলেও আমরা তা পারি কেননা আমাদের বিশ্বাস যিশুতে নিহিত। আপনারা শিল্পীরা অনেক ধৈর্য নিয়ে ও কষ্ট করে অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। আর এরমধ্য দিয়ে মণ্ডলীর প্রতি আপনাদের দরদ ও ভালবাসা প্রকাশ করছেন। আপনাদের একসাথে অভিনয় করা ও চলা বড় একটি সুন্দর আদর্শ অন্যদের সামনে। আপনারা অনেকের কাছে খ্রিস্টের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সকলে একসাথে তা করে যাবেন তা আশা করি।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে থাকে কেক কাটা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরে বাণীদীপ্তির কো-অর্ডিনেটর সিস্টার মেরীয়ানা গমেজ উপস্থিত সকলকে ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার সাথে সংযুক্ত সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এরপর নৈশ ভোজের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজনে ছিলো বাণীদীপ্তি, বিশপীয় সামাজিক যোগাযোগ কমিশন ও সহযোগিতায় ছিল, সিগনিস বাংলাদেশ।