‘যেন তুমি তোমার পুত্র ও পৌত্রদের কাছে বলতে পার’(যাত্রাপুস্তক ১০:২)
জীবন হয়ে উঠে ইতিহাস
আমি এই বছরের যোগাযোগ দিবসের বাণীটি ‘গল্প বলা’র বিষয়ের উপর নিবেদন করতে চাই, কেননা আমি বিশ্বাস করি যে, আমরা যেন আমাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে না ফেলি সেজন্য উত্তম সব গল্পে বিদ্যমান সত্যকে আমাদের নিজের করে নেয়া প্রয়োজন। সেই সব গল্প যা গড়ে তোলে, ভেঙ্গে ফেলে না; সেই সব গল্প যা আমাদের শিকড় ও শক্তিকে পুনঃআবিষ্কার করতে সাহায্য করে, যা একত্রে সামনে অগ্রসর হবার জন্য প্রয়োজন। আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা শ্রæতিকটু সব কণ্ঠ ও বার্তার মাঝে, আমাদের একটি মানবিক গল্প প্রয়োজন যা আমাদের বিষয়ে ও আমাদের চারপাশের সৌন্দর্যের বিষয়ে বলতে পারে। এমন এক কাহিনী যা আমাদের জগত ও এর ঘটনাপ্রবাহকে এক স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে গণ্য করে। এমন এক কাহিনী যা আমাদের বলতে পারে যে আমরা একটি প্রাণময় ও পরষ্পরযুক্ত চিত্রকর্মের অংশ। এমন এক কাহিনী যা এমন সুতার বুনন প্রকাশ করতে পারে যা আমাদেরকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে।
১। গল্প বুনন
মানুষ হলো গল্পকার। ছোটবেলা থেকেই আমরা গল্পের ক্ষুধা অনুভব করি ঠিক যেমনটি আমরা খাদ্যের জন্য ক্ষুধা অনুভব করি। গল্প আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তা রূপকথার কাহিনী, উপন্যাস, ছায়াছবি, গান, খবর যে প্রকারেরই হোক, এমনকি যদি আমরা সর্বদা তা বুঝতে না পারি তবুও। আমরা যে চরিত্র ও গল্পগুলো আমাদের নিজের করে নিয়েছি তার উপর ভিত্তি করেই আমরা প্রায়শঃ নির্ধারণ করি কি সঠিক আর কি ভুল। গল্পগুলো আমাদের জীবনে রেখাপাত করে যায়; সেগুলো আমাদের প্রত্যয় ও আচরণ গঠন করে। আমরা কারা তা বুঝতে ও জানাতে গল্পগুলো আমাদের সাহায্য করে।
আমরাই শুধুমাত্র সেই প্রাণীসত্তা নই যাদের ভঙ্গ অবস্থা ঢাকার জন্য পোষাকের প্রয়োজন হয় (দ্র: আদি ৩:২১); আবার আমরাই শুধুমাত্র সেই প্রাণীসত্তা যাদের জীবন রক্ষা করার জন্য গল্পের দ্বারা ‘আবৃত’ করা প্রয়োজন। আমরা শুধুমাত্র কাপড়ই বুনি না, কিন্তু সেইসাথে গল্পও বুনি: বাস্তবিক, মানুষের ‘বুনন’ (ল্যাটিন `texere’) ক্ষমতা শুধুমাত্র আমাদের কাপড় (textile) শব্দটাই দেয় না বরং কথন (text) শব্দটিও দান করে। বিভিন্ন যুগের গল্পের সবগুলোতেই রয়েছে এক অভিন্ন ‘তাঁত’ সেগুলোর বর্ণনার সুতায় জড়িয়ে আছে ‘নায়কগণ’, যার মধ্যে নিত্যদিনের নায়কেরাও আছেন, যারা একটি স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হন এবং মন্দতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, এমন এক শক্তি দ্বারা চালিত হন যা তাদেরকে সাহসী করে তোলে, আর সেই শক্তি হলো ভালবাসার শক্তি। গল্পের মধ্যে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করে আমরা জীবনের চ্যালেঞ্জসমূহ বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করার অর্থ খুঁজে পেতে পারি।
আমরা মানুষেরা গল্পকার কারণ আমরা অবিরাম বৃদ্ধির এক প্রক্রিয়ায় যুক্ত, আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এবং আমাদের জীবনের দিকগুলোর আলপনায় আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি। তথাপি, ঠিক সেই আদিকাল থেকেই আমাদের গল্প হুমকির মুখে পড়েছে: মন্দতা ইতিহাসের মধ্য দিয়ে এর পথ করে নেয়।
২। সব গল্পই উত্তম গল্প নয়
‘যখন তোমরা এই ফল খাবে… তোমরা পরমেশ্বরের মতো হয়ে যাবে’ (দ্র: আদিপুস্তক ৩:৪): সাপের সেই প্রলোভন ইতিহাসের মূল কাঠামোতে এমন এক জট বাঁধায় যা খোলা মুসকিল। ‘যদি তোমার অধিকারে থাকে, তুমি হয়ে উঠবে, তুমি অর্জন করবে..’। এই বার্তাটা এখনও সেই সব মানুষ ফিসফিস করে যারা গল্প বলাকে শোষণমূলক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়। এমন কতো গল্প আছে যা আমাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়, আমাদের মধ্যে এই প্রত্যয় জাগায় যে সুখী হওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রতিনিয়ত অর্জন করতে, অধিকার করতে ও ভোগ করতে হবে। আমরা এমনকি হয়তো উপলব্ধিও করতে পারি না যে, প্যাচাল আর গুজবের প্রতি আমরা কত লোভী হয়ে উঠেছি, আর কত বেশী হিংস্রতা আর মিথ্যাচার আমরা গ্রহণ করছি। প্রায়শই যোগাযোগ মাধ্যমের মঞ্চে আমরা তেমন গঠনমূলক গল্প খুঁজে পাই না যা বন্ধন ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে জোরালো করতে কাজে আসে; এর পরিবর্তে আমরা সেই সব ধ্বংসাত্মক ও প্ররোচনামূলক গল্প খুঁজে পাই যা সমাজ হিসেবে আমাদেরকে একত্রে বেঁধে রাখার ঝুঁকিপূর্ণ সুতা দূর্বল করে দেয় আর ছিঁড়ে ফেলে। ছোট ছোট যাচাইহীন তথ্য জোড়া লাগিয়ে, তুচ্ছ ও ছলনাপূর্ণভাবে প্ররোচনাময় যুক্তি পুনরাবৃত্তি করে, কর্কশ ও ঘৃণাপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে আমরা মানব ইতিহাস বুনতে সাহায্য করি না, বরং এর পরিবর্তে অন্যদের কাছ থেকে তাদের মর্যাদা হনন করি।
কিন্তু শোষণমূলক ব্যবহার ও ক্ষমতার জন্য প্রয়োগ করা গল্পের আয়ুষ্কাল খুবই সংক্ষিপ্ত, অন্যদিকে উত্তম গল্প স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করতে পারে। বহু শতাব্দী পরেও এটা সময়োপযোগী থাকে, কেননা তা জীবনকে পরিপুষ্ট করে।
বর্তমানের এমন এক সময়কাল যখন মিথ্যাচার ক্রমবর্ধমানভাবে কৃত্রিমতা লাভ করছে, আর চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে (বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভিডিওতে অবিকল নকল কন্ঠ ও ভাষ্য যেভাবে দেয়া হয়), এমতাবস্থায় আমদের প্রজ্ঞার প্রয়োজন যেন আমরা সুন্দর, সত্য ও উত্তম গল্পগুলোকে স্বাগতম জানাতে ও সৃষ্টি করতে পারি। মিথ্যা ও মন্দ গল্পগুলোকে পরিত্যাগ করার সাহস আমাদের থাকতে হবে। বর্তমান সময়ের নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যোগসূত্র না হারাতে যে গল্পগুলো আমাদেরকে সাহায্য করে সেগুলোকে পুনঃআবিষ্কার করার জন্য আমাদের ধৈর্য ও বিচক্ষণতা থাকতে হবে। আমাদের সেইসব গল্প প্রয়োজন যা প্রকাশ করে আমরা সত্যিকারভাবে কে, এবং প্রতিদিনকার জীবনে না বলা বীরত্বের মধ্যেও যা প্রকাশ করে।
৩। সব গল্পের সেরা গল্প
পবিত্র শাস্ত্র হলো একটি সেরা গল্প। এই শাস্ত্র কত কত ঘটনা, জনগণ ও ব্যক্তিবর্গকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে! এই শাস্ত্র সেই সূচনাকাল থেকেই আমাদের কাছে এমন এক ঈশ্বরকে তুলে ধরে যিনি একাধারে সৃষ্টিকর্তা ও বর্ণনাকারী। বাস্তবিক, ঈশ্বর কথা বলেন এবং সেগুলো অস্তিত্ব লাভ করে (দ্র: আদিপুস্তক ১)। একজন বর্ণনাকারীরূপে ঈশ্বর সেসবকিছুকে ডেকে প্রাণ দান করেন, যার শেষ হয় নর ও নারী সৃষ্টির মধ্য দিয়ে; যারা হলেন তাঁর স্বাধীন সংলাপ-সঙ্গী, যারা তাঁর পাশাপাশি ইতিহাস তৈরী করেন। একটি সামসঙ্গীতে সৃষ্টি তার স্রষ্টাকে বলে: ‘তুমিই গঠন করেছ আমার অন্ত্ররাজি, তুমিই আমায় বুনে বুনে গড়েছ আমার মাতৃগর্ভে। আমি তোমার স্তুতি করি, তুমি যে ভয়ঙ্করভাবেই আমাকে করেছ অপরূপ…আমি যখন গোপনে হচ্ছিলাম সংগঠিত, পৃথিবীর গভীরে যখন হচ্ছিল এ দেহের বয়ন’ (১৩৯: ১৩-১৫)। আমরা পূর্ণাঙ্গ হয়ে জন্ম নেই না, কিন্তু আমাদের প্রতিনিয়ত ‘বুনে নিতে’ হয়, ‘একত্রে সেলাই করতে হয়’। আমাদের জীবনটা আমাদের কাছে একটা আমন্ত্রণ হিসেবে দেয়া হয়েছে যেন, আমরা যে ‘অপূর্ব’ রহস্য তা যেন আমরা বুনে যেতে থাকি।
এভাবে বাইবেল হলো ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার মহা ভালবাসার গল্প। এর কেন্দ্রে দন্ডায়মান আছেন যিশু যার নিজের গল্প আমাদের জন্য ঈশ্বরের ভালবাসা এবং ঈশ্বরের জন্য আমাদের ভালবাসা উভয়ের পূর্ণতা নিয়ে আসে। অতঃপর, প্রতিটি প্রজন্মে, নর নারীরা আহ‚ত হয়েছে সকল গল্পের সেরা এই গল্পের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়গুলো বর্ণনা করতে ও স্মৃতি ধারন করতে, সেই অধ্যায়গুলো যা সর্বোত্তমরূপে এর অর্থ প্রদান করে।
এই বছরের বাণীর শিরোনাম গ্রহণ করা হয়েছে যাত্রাপুস্তক গ্রন্থ থেকে, যা হলো বাইবেলের একটি মৌলিক গল্প যেখানে ঈশ্বর তাঁর জনগণের ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করেন। যখন দাসত্বে আবদ্ধ ইস্রায়েলের সন্তানেরা তাঁকে চিৎকার করে ডাকে, তখন ঈশ্বর শুনেন ও স্মরণ করেন: ‘আব্রাহাম, ইসায়াক ও যাকোবের সঙ্গে তাঁর সেই সন্ধির কথা স্মরণ করলেন। পরমেশ্বর ইস্রায়েল সন্তানদের দিকে তাকালেন; পরমেশ্বর এই ব্যাপারে মনোযোগ দিলেন’ (যাত্রাপুস্তক ২:২৪-২৫)। ঈশ্বরের এই স্মরণ এক ধারাবাহিক নিদর্শনকর্ম ও আশ্চর্যকাজের মধ্য দিয়ে নির্যাতন থেকে মুক্তি নিয়ে আসে। এরপর ঈশ্বর মোশীর কাছে এই সব নিদর্শনকর্মের অর্থ প্রকাশ করেন: ‘তাদের মাঝে আমার যে সমস্ত চিহ্ন দেখিয়ে দিয়েছি, তা যেন তুমি তোমার পুত্র ও পৌত্রের কাছে বর্ণনা করতে পার, ফলত তোমরা যেন জানতে পার যে, আমিই প্রভু ’ (যাত্রাপুস্তক ১০:২)। যাত্রাপুস্তকের অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ঈশ্বরের সম্বন্ধে জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হস্তান্তর করা হয় মূলতঃ ঈশ্বর কিভাবে নিজের উপস্থিতি ঘটিয়ে যান সেই গল্প বলার মধ্য দিয়ে। জীবনের ঈশ্বর জীবনের গল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
যিশু বিমূর্ত ধারণা নিয়ে ঈশ্বরের বিষয়ে কথা বলেননি, তিনি কথা বলেছেন উপমার মধ্য দিয়ে, প্রতিদিনকার জীবন থেকে নেয়া ছোট ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে। এই পর্যায়ে জীবন হয়ে উঠে গল্প আর তারপর, শ্রোতার জন্য সেই গল্প হয়ে উঠে জীবন: যারা সেই গল্প শোনে তাদের জীবনের অংশ হয়ে যায়, আর এটা তাদেরকে পরিবর্তন করে।
মঙ্গলসমাচারগুলোও হলো গল্প, আর সেটা আকস্মিকভাবে নয়। সেই গল্পগুলো যিশুর বিষয়ে বললেও, সেগুলো আসলে ‘ভূমিকা পালনকারী’ সেগুলো আমাদেরকে যিশুর সঙ্গে অনুরূপ করে। মঙ্গলসমাচার পাঠকের কাছে একই বিশ্বাসের সহভাগিতা যাচ্ঞা করে যেন একই জীবনের সহভাগী হওয়া যায়। যোহনের মঙ্গলসমাচার আমাদেরকে বলে যে সেই প্রকৃত গল্পকার -ঐশবাণী- নিজেই গল্পে পরিণত হন: সেই একমাত্র পুত্র যিনি পিতার কোলে বিরাজমান, তাঁকে তিনিই প্রকাশ করেছেন” (যোহন ১: ১৮)। মূল ক্রিয়াপদটি (exegésato) ‘প্রকাশ করেছেন’ আর ‘বর্ণনা করেছেন’ উভয় প্রকারেই অনুবাদ করা যায়। ঈশ্বর আমাদের মানবতার মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে বুনেছেন, আর তাই আমাদের নিজেদের গল্প বুননের জন্য তিনি আমাদেরকে এক নতুন পন্থা দিয়েছেন।
৪। এক চির নবায়িত গল্প
খ্রিস্টের ইতিহাস অতীতের কোন কর্মকাণ্ড নয়; এটা আমাদের গল্প আর সর্বদাই তা সময়োপযোগী। এটা আমাদের দেখায় যে, মানবজাতির জন্য, আমাদের দেহ ও আমাদের ইতিহাসের জন্য ঈশ্বরের গভীর অনুভব ছিল, তা এমন পর্যায় পর্যন্ত যে তিনি মানুষ, দেহ এবং ইতিহাস হয়ে উঠেছিলেন। এটা এও আমাদের বলে যে, কোন মানবিক গল্পই তাৎপর্যহীন বা নগণ্য নয়। যেহেতু ঈশ্বর গল্প হয়ে উঠেছিলেন, তাই প্রতিটি মানবিক গল্পই হলো কোন এক অর্থে একটি ঐশরিক গল্প। প্রতিটি ব্যক্তির ইতিহাসেই, স্বর্গীয় পিতা পুনরায় তাঁর পুত্রের গল্প দেখতে পান, যে পুত্র জগতে নেমে এসেছিলেন। প্রতিটি মানবিক গল্পেই রয়েছে এক দুর্দমনীয় মর্যাদা। ফলশ্রæতিতে, মানবজাতির সেই গল্পের অধিকার রাখে যা এর উপযুক্ত, যা সেই মাথা ঘুরানো ও মোহনীয় উচ্চতার যোগ্য যে উচ্চতায় যিশু একে উঠিয়েছেন।
সাধু পল লিখেছেন, ‘তোমরা খ্রিস্টের একটি পত্র যা আমাদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে; আর এই পত্রের লেখা কালির নয়, জীবনময় ঈশ্বরের আত্মারই লেখা, পাথরের ফলক নয়, রক্তমাংসের হৃদয় ফলকেই লেখা’ (২ করিন্থিয় ৩:৩)। পবিত্র আত্মা যিনি হলেন ঈশ্বরের ভালবাসা, তিনি আমাদের মধ্যে লিখছেন। আর যখন তিনি আমাদের মধ্যে লিখেন তখন তিনি আমাদের মধ্যে মঙ্গলময়তা প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিরন্তর এ বিষয়ে মনে করিয়ে দেন। বাস্তবিক, ‘মনে করিয়ে দেয়ার’ অর্থ হলো মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনা, অন্তরের মধ্যে ‘লিপিবদ্ধ করা’। পবিত্র আত্মার শক্তিতে প্রতিটি গল্পই, এমনকি সবচেয়ে বিস্মৃত গল্প, এমনকি সেই গল্প যা মনে হয় সবচেয়ে কুটিল করে লেখা হয়েছে, সেটাও অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে উঠতে পারে, একটি শ্রেষ্ঠকীর্তি হিসেবে নতুন করে জন্ম নিতে পারে, আর মঙ্গলসমাচারের একটি পরিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারে। সাধু আগষ্টিনের স্বীকারোক্তির মতো। সাধু ইগ্নেসিউসের তীর্থযাত্রীর যাত্রার মতো। বালক যিশু ভক্তা সাধ্বী তেরেজার আত্মার এক কাহিনীর মতো। সেই বাগদত্তার মতো, কারামাজভের সেই ভ্রাতৃবর্গের মতো। অগণিত অন্যান্য কাহিনীর মতো যা ঈশ্বরের স্বাধীনতা ও মানুষের স্বাধীনতার মধ্যকার সাক্ষাৎ প্রশংসনীয়ভাবে লিপিবদ্ধ করেছে। আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী জানি যার মধ্যে মঙ্গলসমাচারের সুবাস রয়েছে, যা সেই ভালবাসার সাক্ষ্য বহন করেছে যে ভালবাসা জীবন রূপান্তর করে। এই গল্পগুলো চিৎকার করে বলে যেন তা সহভাগিতা করা হয়, বর্ণনা করা হয় এবং প্রতিটি যুগে, প্রতিটি ভাষায় ও প্রতিটি মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে আনা হয়।
৫. এমন এক গল্প যা আমাদের নবায়ন করে
আমাদের নিজেদের গল্প প্রতিটি মহান গল্পের অংশ হয়ে ওঠে। যখন আমরা পবিত্র শাস্ত্র পাঠ করি, সাধু-সাধ্বীদের জীবনী পাঠ করি, অথবা সেই সব পাঠ্য পড়ি যা মানব হৃদয়ে এর আলো ও এর সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে, তখন পবিত্র আত্মা আমাদের হৃদয়ে লেখার জন্য স্বাধীন, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আমরা কী তিনি তা আমাদের স্মৃতিতে পুন:জাগ্রত করেন। যখন আমরা সেই ভালবাসার কথা স্মরণ করি যা আমাদের সৃষ্টি করেছে ও পরিত্রাণ দিয়েছে, যখন ভালবাসাকে আমরা আমাদের প্রতিদিনকার গল্পের একটি অংশ করি, যখন আমরা দয়া দিয়ে আমাদের দিনগুলোর একটি চিত্রকর্ম বুনন করি, তখন আমরা আরেকটি পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি। আমরা আর আফসোস করে আর বিষন্নতায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকি না, যা একটি অস্বাস্থ্যকর স্মৃতির দিকে ঠেলে দেয় যা আমাদের হৃদয়কে ভারগ্রস্ত করে; বরং, অন্যদের প্রতি আমাদের নিজেদেরকে উন্মুক্ত করে। আমরা আমাদেরকে সেই মহান গল্পকারের একই দর্শনের প্রতি নিজেদেরকে উন্মুক্ত করি। ঈশ্বরকে আমাদের গল্প বলা কখনোই অর্থহীন নয়: এমনকি যদি ঘটনাসমূহের বিবরণ একই থেকে যায় তথাপি এর অর্থ ও দৃষ্টিভঙ্গী সর্বদা পরিবর্তনশীল। প্রভুকে আমাদের গল্প বলার অর্থ হলো আমাদের ও অন্যদের প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল ভালবাসার দৃষ্টিতে প্রবেশ করা। আমরা যে গল্পে বাস করছি আমরা তার বিবরণ তাঁকে দিতে পারি, যেসব ব্যক্তি ও পরিস্থিতি আমাদের জীবনকে পূর্ণ করে সেসব তার কাছে নিয়ে আসতে পারি। তাঁর সঙ্গে আমরা জীবনের কাঠামো পুনরায় বুনন করতে পরি, ছিঁড়ে ফেলা অংশ আর কান্না জোড়া লাগাতে পারি। আমাদের প্রত্যেকেরই কত বেশী করেই না ঠিক এই কাজটাই করা উচিত!
সেই মহান গল্পকারের দৃষ্টি দিয়ে- এমমাত্র তিনিই যার চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে- আমরা এরপর অন্যান্য চরিত্র অর্থাৎ আমাদের ভাই-বোনদের দিকে অগ্রসর হতে পারি, যারা বর্তমান সময়ের গল্পে আমাদের সঙ্গে অভিনেতা-নেত্রী হিসেবে আছেন। কেননা জগতের মঞ্চে কেউই অতিরিক্ত নয়, আর প্রত্যেকের গল্পই সম্ভাব্য পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত। এমনকি যখন আমরা মন্দতার বিষয়ে কথা বলি তখন আমরা পরিত্রাণের জন্য কক্ষ ত্যাগ করা শিখতে পারি; মন্দতার মাঝে, আমরা মঙ্গলময়তার কাজ সনাক্ত করতে পারি আর একে সময় দিতে পারি।
তাই এটা এরকম নিছক গল্প বলার একটা বিষয় নয়, অথবা নিজেদের প্রচার করার বিষয় নয়, বরং স্মরণ করার বিষয় যে আমরা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কি এবং কারা, পবিত্র আত্মা আমাদের হৃদয়ে যা লেখেন সেই বিষয়ে সাক্ষ্য বহন করা আর সবার কাছে প্রকাশ করা যে, তার গল্পে অপূর্ব কিছু বিষয় রয়েছে। এটা করার জন্য, আসুন আমরা আমাদেরকে সেই নারীর কাছে ন্যস্ত করি যিনি তার গর্ভে ঈশ্বরের মনুষ্যত্ব বুনে বুনে গড়েছেন, আর মঙ্গলসমাচার আমাদের বলে যে তিনি তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ একসঙ্গে জুড়েছেন। কেননা কুমারী মারীয়া “এই সব ঘটনা গেঁথে রেখে হৃদয়গভীরে তার অর্থ বিবেচনা করতেন” (লুক ২:১৯)। আসুন আমরা তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি, যিনি জানতেন কিভাবে ভালবাসার কোমল শক্তি দিয়ে জীবনের জট খুলতে হয়:
হে কুমারী জননী মারীয়া, তুমি তোমার গর্ভে ঐশবাণীকে বুনেছ, তুমি তোমার জীবন দ্বারা ঈশ্বরের মহিমাকীর্তি বর্ণনা করেছ। তুমি আমাদের গল্পগুলো শোন, সেগুলোকে তোমার হৃদয়ে আঁকড়ে রাখো, আর যে গল্পগুলো কেউ শুনতে চায় না সেগুলোকে তোমার নিজের করে নাও। যে উত্তম সূতাগুলো ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় সেগুলো সনাক্ত করতে আমাদের শেখাও। আমাদের জীবনে প্যাঁচানো জটগুলোর দিকে তাকাও যেগুলো আমাদের স্মৃতিকে অবশ করে দেয়। তোমার কোমল হাত দিয়ে সব জটই খুলে যেতে পারে। পবিত্র আত্মার দ্বারা চালিত হে নারী, তুমি আস্থার জননী, আমাদেরকেও তুমি অনুপ্রাণিত কর। শান্তির গল্প গড়ে তুলতে তুমি আমাদের সাহায্য কর, যে গল্পগুলো ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করে । আর সেগুলোর সাথে একত্রে জীবনযাপনের পথও তুমি আমাদের দেখাও।
রোমের সাধু যোহন লাতেরান মহামন্দির থেকে ২৪ জানুয়ারী ২০২০, খ্রিস্টাব্দ
সাধু ফ্রান্সিস দ্য সালের স্মরণদিবসে প্রদত্ত।
পোপ ফ্রান্সিস
(অনুবাদ : ফাদার তুষার জেমস্ গমেজ)