আজ ১৯ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বনানীতে অবস্থিত বাংলাদেশ খ্রিস্টান সমাজের একমাত্র উচ্চ সেমিনারী ‘পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী’ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী শত—সহস্র জনগণ নিয়ে ঈশ্বর বন্দনায় ও আনন্দ—গানে পালন করা হয়। বাংলাদেশের একমাত্র কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও’র উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রাণ্ডাল। সকাল ৮:৩০ মিনিটে কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও’র জাতীয় পতাকা উৎত্তোলনের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সকল ডায়োসিসের বিশপগণ। জাতীয় সঙ্গীতের পর পরই জুবিলী উপলক্ষে নির্মিত ‘স্মারক স্মৃতির’ মোড়ক উন্মোচন ও আশীর্বাদ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকার আর্চবিশপ ও বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ, ওএমআই।
সকাল ৯টায় জুবিলীর মূল অনুষ্ঠান পবিত্র খ্রিস্টযাগ শুরু হয় কার্ডিনালের পৌরহিত্যে। তার সাথে ছিলেন ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রাণ্ডাল; আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ, ওএমআই; আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি; বিশপ জের্ভাস রোজারিও, বিশপ জেমস রমেন বৈরাগি, বিশপ পল পনেন কুবি, বিশপ সেবাস্টিয়ান টুডু, বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ, বিশপ ইম্মানুয়েল রোজারিও ও ফাদার সুব্রত বনিফাস গমেজ (বিশপ মনোনীত)। এছাড়াও দুই শতাধিক যাজক, বেশ কিছু সংখ্যক ব্রাদার, সিস্টার ও খ্রিস্টভক্তসহ মোট ৮৪০ জন উপস্থিত ছিলেন।
খ্রিস্টযাগের উপদেশে মহামান্য কার্ডিনাল পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী প্রতিষ্ঠা ঈশ্বরের একটি মহাদান ও অনুগ্রহ বলে উল্লেখ করেন এবং একে বাংলাদেশ খ্রিস্ট মণ্ডলীর হৃদয় হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ মণ্ডলী স্থানীয় হয়ে ওঠার যাত্রায় রয়েছে। এ সেমিনারী থেকে শিক্ষা নিয়ে মণ্ডলী পরিচালনায় সেবাময় নেতৃত্ব দিচ্ছে যাজকগণ, সন্ন্যাসব্রতী ও সন্ন্যাসব্রতিনীগণ। তাই কার্ডিনাল মহোদয় আহ্বান করেন, এখানকার শিক্ষার্থীরা যেন উত্তম মেষপালকের আদর্শ অনুসরণ করে মেষের গাঁয়ের গন্ধ নিতে জানে এবং সিনড বিশিষ্ট মণ্ডলী গড়ে তুলতে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে।
অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যময় খ্রিস্টযাগে বিভিন্ন ভাষায় উপাসনা সঙ্গীত পরিবেশন সকলকে বিমোহিত করে। খ্রিস্টযাগের পর বিশপগণ ও যাজকগণ একসাথে ছবি তুলেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকলের জন্যই ছিল বিশেষ জলযোগ।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশে ছিল সোনালী স্মৃতিচারণ। বিশপীয় সেমিনারী কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিশপ ইম্মানুয়েল রোজারিও’র স্বাগত বক্তব্যের পর জুবিলী উৎসবের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাজশাহীর বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তিনি পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে এ সেমিনারীতে অধ্যাপনা ও অধ্যয়নরত শিক্ষক—শিক্ষার্থীদের একসাথে পথ চলা, গবেষণা ও ঐশতাত্ত্বিক লেখনীর উপর জোর দেন। মূল বক্তব্য উপস্থাপনের পর ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু’র গ্রন্থণায় ও পরিচালনায় প্রামাণ্য দলিল ‘গৌরবে সৌরভে পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী’ প্রদর্শিত হয়। এরপর ফাদার কোমল খাঁ সম্পাদিত জুবিলীর বিশেষ স্মরণিকা ‘প্রজ্ঞাপ্রবাহ’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি আর্চবিশপ রাণ্ডাল। অতঃপর উক্ত সেমিনারীর ছাত্র ও অধ্যাপক ফাদার প্রশান্ত থিওটোনিয়াস রিবেরু, আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ ক্রুজ, সিবিসিবি’র সেক্রেটারী জেনারেল ময়মনসিংহের বিশপ পল পনেন কুবি, সিএসসি স্মৃতিচারণ ও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রাণ্ডাল সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সেমিনারীর পরিচালকমণ্ডলী, শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে এ মহতী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে তার আনন্দ প্রকাশ করেন।
দুপুরের প্রীতিভোজে যাজক, প্রাক্তন সেমিনারীয়ান ও আমন্ত্রিত অতিথিরা একসাথে অংশগ্রহণ করেন। দুপুর ৩টায় শুরু হয় জুবিলীর আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরিশীলিত এই অনুষ্ঠানে বিভিন্নস্থানের শিল্পী ও সেমিনারীয়ানগণ অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী অনিমা মুক্তি গোমেজও এই বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনসহ গান পরিবেশন করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে মহামান্য কার্ডিনাল ছোট প্রার্থনা পরিচালনা ও আশীর্বাদের মধ্য দিয়ে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেন।
উল্লেখ্য ২৩ আগস্ট ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে পুণ্যপিতা পোপের প্রতিনিধি মহামান্য আর্চবিশপ এডুয়ার্ড ক্যাসিডি রমনা ক্যাথিড্রাল গির্জায় সহার্পিত খ্রিস্টযাগের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয় উচ্চ সেমিনারী’র উদ্বোধন করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতীয় উচ্চ সেমিনারী’ ৬ জন অধ্যাপক ও ৫ জন সেমিনারীয়ান নিয়ে ম্যাথিস হাউজে যাত্রা শুরু করে। ৫০ বছরের এই যাত্রায় মোট ৯৮৭জন শিক্ষার্থী পবিত্র আত্মা সেমিনারীতে পড়াশুনা করেছেন। এদের মধ্যে ৯জন বিশপ সহ যাজক হয়েছেন ৪৪৫জন। এছাড়াও ৮৩ জন ব্রাদার ও ১১ জন সিস্টার সেমিনারীর শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন। আলো বিকিরণের এ কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন ও আছেন মোট ১০৩জনের অধ্যাপকমণ্ডলী।
এ সেমিনারী থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের ৮টি ধর্মপ্রদেশের আনাচে কানাচে, কেউ কেউ আবার দেশের বাইরেও বিবিধ পালকীয়, সংস্কারীয় কাজ করছেন। পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীর শিক্ষায় প্রশিক্ষিত অনেক যাজক, ব্রতধারী ও ব্রতধারিণী আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমেরিকা, কানাডা, ব্রাজিল, ইতালি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সেবাদায়িত্ব পালন করে পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারীর সৌরভ ছড়াচ্ছেন।
– ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু