ভূমিকা : বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ঐতিহাসিক সুসং দুর্গাপুর। গারো পাহাড়ের গা ছুঁয়ে প্রবাহিত পাহাড়ী-কন্যা সোমেশ্বরী নদী। নদী তীরে পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত রাণীখং সাধু যোসেফ ধর্মপল্লী’র গির্জা। পাহাড়, নদী আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য লীলায় মন্ডিত রাণীখং। সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আদিবাসীদের বসবাস। প্রকৃতি পূজক পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর কাছে বিদেশী ধর্মপ্রচারকগণ জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে বহু কষ্টে এই দুর্গম অঞ্চলে খ্রিস্টের প্রেম ও শান্তির বাণী বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা আজীবন পরিশ্রম করেছেন মান্দিদের সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে খ্রিস্টীয় আলোর পথে পরিচালনা করতে।
সর্বপ্রথম ভিন্ন মণ্ডলীর প্রচারকের মুখে সত্য মণ্ডলীর ধারণাটা রেখাপাত করে কয়েকজন সত্যধর্ম পিপাসু মান্দিদের মনে। এদের মধ্যে জিরিং আন্দ্রিয় হাজং, উজির জেমস্ রুরাম, থিমান ফ্রান্সিস দাংগো, থদিং যোসেফ হাজং ও সিন্ধু মোড়ল (সিন্ধু রুগা) এই পাঁচজন ব্যক্তি ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে রাণীখংয়ের থাউশালপাড়া গ্রাম থেকে বহু কষ্টে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে যান। ঢাকায় তারা তৎকালীন বিশপ ফ্রেডেরিক লিনেবর্নের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের এলাকায় কাথলিক ফাদার পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানান। প্রকৃতপক্ষে তারাই প্রথম খ্রিস্টের বাণীরূপ বীজ বপন করেছিলেন ময়মনসিংহ এলাকায়। এভাবে মণ্ডলীর কর্তৃপক্ষগণ নানা পর্যবেক্ষণের পর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে থাউশাল পাড়ায় মান্দিদের মাঝে প্রথম প্রেরণ করেন ফাদার এডলফ ফ্রান্সিসকে। এখানেই তিনি প্রাথমিকভাবে মিশনারী কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সুসং দুর্গাপুরের রাজার কাছ থেকে রাণীখং পাহাড়টি ক্রয় করে সেখানে থাউশালপাড়ার গির্জাটি স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়। সেদিনের সাধু যোসেফের গির্জাটি বর্তমানে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।
পটভূমি : তৎকালে হিন্দু, মুসলমান ও প্রোটেষ্টানদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশ করা হতো। এসব সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে কাথলিকদের সংবাদ ও মতামত স্থান পেতো না। কাথলিক ধর্ম রক্ষা, কাথলিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত করা, অজ্ঞানতা বিদূরিত করা এবং যাজক শ্রেণী ও কাথলিকদের আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্দেশেই মণ্ডলীর পরিচালকগণ প্রকাশনার উপর গুরুত্ব দেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের Catholic Directory of India অনুসারে দেখা যায়, সারা ভারতে তখন ১১৩টি কাথলিক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছিল। এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত A Indo Portugueza, সিংহলের Catholic Messenger (১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ) জাফনা থেকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত ও প্রকাশিত Catholic Guardian এবং মাদ্রাজ হতে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত ও প্রকাশিত Catholic Leader. এগুলো সবই সাপ্তাহিকী ছিল। উল্লেখ্য যে, ঢাকার বিশপ পিটার যোসেফ হার্থের আমলে (১৮৯৪-১৯০৯) ‘হলিক্রস ভের্নাক্যুলার বুকলেট সিরিজ’ নামে সমগ্র বঙ্গে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় ধর্মীয় পুস্তক – পুস্তিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
ধর্ম-জ্যোতি : দূরদর্শী বিশপ ল্যগ্রাঁ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের নববর্ষ শুরু করেন ‘ধর্ম-জ্যোতি’ নামে একটি ধর্মপ্রদেশীয় সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে। সমগ্র বঙ্গে এটাই ছিল বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম কাথলিক সাময়িকী। ঢাকার লক্ষ্মীবাজারস্থ ক্যাথিড্রাল থেকে প্রকাশিত সাময়িকীর প্রথম সম্পাদক ছিলেন ফাদার আলফ্রেড ল্যাপায়ের সিএসসি।
উল্লেখ্য যে, ফাদার ল্যাপায়ের ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ধর্মজ্যোতির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। একই বছরের মে মাস থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত ফাদার ডেরোশী সিএসসি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি থেকে ফাদার তিমথী জে. ক্রাউলী সিএসসি সম্পাদক ও প্রকাশক নিযুক্ত হন। কিন্তু একই বছর তিনি ঢাকার বিশপ নিযুক্ত হবার পর বিভিন্ন দায়িত্বে ব্যস্ত হয়ে পড়ার দরুণ কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়নি। অবশেষে দেড় যুগ পর ‘ধর্ম-জ্যোতি’ বন্ধ হয়ে যায়।
নব উদ্যোগ ঃ ‘ধর্ম-জ্যোতি’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানাধীন রাণীখং ধর্মপল্লীতে কর্মরত ফাদার রিচার্ড ডুয়েন প্যাট্রিক সিএসসি।
রাণীখং মিশন চিঠি : ফাদার রিচার্ড ডুয়েন প্যাট্রিক ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বর্তমান জাতীয় সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর আদিপুরুষ ‘রাণীখং মিশন চিঠি’ ময়মনসিংহ শহরের উদয়ন মুদ্রণালয় থেকে ছাপিয়ে প্রকাশ করেন। মূলত এটি একটি ‘প্যারিশ বুলেটিন’ রূপে প্রকাশিত হয়। ‘রাণীখং মিশন চিঠি’ প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে, ময়মনসিংহের রাণীখং মিশন থেকে। পত্রিকার সাইজ ছিল লম্বা ৯ ইঞ্চি ও প্রস্থে ৭ ইঞ্চি। প্রথম পৃষ্ঠাতে পত্রিকার কোন লোগো বা মনোগ্রাম ব্যবহৃত হয়নি। মোট তিন পাতার অর্থাৎ ছয় পৃষ্ঠার পত্রিকা। কোন রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নেই। পেছনের শেষ কভারে নিচের অংশে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে Q Published by Rev. Patrick csc cum Permissu Superioris and Printed by Dhirendra Chandra De at the Udayan Press, Mymensingh.
কাথোলিক মিশন পত্রিকা : প্রথম সংখ্যাটি ময়মনসিংহ এলাকার বাইরেও সমাদৃত হওয়ায় এবং আঞ্চলিকতার ভাব দূরীকরণার্থে পূর্বের নাম পরিবর্তন করে দ্বিতীয় সংখ্যাটির (ডিসেম্বর ১৯৪১) নামকরণ হয় ‘কাথোলিক মিশন পত্রিকা’। প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস হতে জুলাই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই নামে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এ সময় পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ফাদার প্যাট্রিক ঢাকা জেলার মঠবাড়ী মিশনে বদলী হওয়াতে এবং অন্যান্য সুবিধার নিমিত্তে পত্রিকার সম্পাদনা দপ্তর ময়মনসিংহ শহরের কাথলিক মিশনে স্থানান্তর করা হয়। পত্রিকা পরিচালনার ভার (সম্পাদনা ও প্রকাশনা) ময়মনসিংহ কাথলিক মিশনের উপর অর্পিত হয়।
কাথলিক মিশন পত্রিকা : ‘কাথলিক মিশন পত্রিকা’ ময়মনসিংহ এই নামে ৭ম সংখ্যাটি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মে মাস থেকে জুলাই এর ৯ম সংখ্যা পর্যন্ত চলে। জুন সংখ্যায় দেখা যায় পত্রিকার মূল্য প্রতি সংখ্যা দুই পয়সা বার্ষিক মূল্য আট আনা ডাকমাশুলসহ ধার্য করা হয়েছে। জুলাই মাসে পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয় ২৮৪৬। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস হতে পত্রিকার দশম সংখ্যাটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘কাথলিক মিশন পত্রিকা’। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এর সম্পাদনা দপ্তর পুনরায় ঢাকায় চলে আসে। পুরোনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারস্থ হলিক্রস গির্জা, ৮২ মিউনিসিপ্যাল অফিস স্ট্রিট, ঢাকা-১ থেকে এটি প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দ এপ্রিল হতে ১৯৪৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কোন সম্পাদকের নাম পাওয়া যায়নি। শুধু লেখা ছিল কাথলিক মিশন কর্তৃক প্রকাশিত। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সংখ্যা হতে পত্রিকার মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। বার্ষিক সডাক ১টাকা এবং প্রতি সংখ্যার মূল্য ১ আনা। কাথলিক মিশন পত্রিকার মূলনীতি ছিল প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, কথোপকথন এবং সংবাদের মাধ্যমে কাথলিক জনগণকে ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে রাখা। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কাথলিক মিশন পত্রিকার সম্পাদক হন শ্রীক্ষিতিশ চন্দ্র সত্যব্রত। তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন। প্রয়াত ফাদার যাকোব দেশাই প্রদত্ত তথ্য অনুসারে জানা যায়, শ্রী ক্ষিতিশ চন্দ্র সত্যব্রত ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থানরত যাজকদের তত্ত্বাবধানে তিনি পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন।
প্রতিবেশী : ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রতিবেশী’র ইতিহাসে এক নব যুগ সূচীত হয়। মে মাসে ‘কাথলিক মিশন পত্রিকা’ একই সম্পাদকের সম্পাদনায় নতুন নাম পরিগ্রহ করে। এর নাম হয় ‘প্রতিবেশী’। নতুন পত্রিকাটির নীতিমালা ছিল ১) নৈতিক বিষয় সম্বন্ধে সম্পাদকীয় ২) অতীত বা বর্তমানকালের কোন দুর্ঘটনা বা খবরের সমালোচনা ৩) নৈতিক উন্নতি বিষয়ক কোন গল্প বা ঘটনা ৪) মিশনস্থ নানা সংবাদ, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যনিষ্ঠা, স্বাদেশিকতা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালবাসা, পরকালে স্বর্গলাভের উপায় ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়াই ইহার মূল উদ্দেশ্য। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ফাদার উইলিয়াম মনাহান সিএসসি নতুন সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর সংখ্যা থেকে প্রতিবেশী ম্যাগাজিন সাইজ থেকে আরও লম্বা ‘ট্যাবলয়েড’ সাইজ ধারণ করে। এতে পত্রিকা হিসেবে এর মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। শিশু কিশোরদের জন্য কিশোরদের আসর নামে বিভাগটি শুরু হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এই নামে চলে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট সংখ্যা পর্যন্ত। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর হতে কিশোরদের আসর নাম পরিবর্তন করে ‘ছোটদের আসর’ রাখা হয়, যা অদ্যাবধি বহাল রয়েছে।
সাপ্তাহিক প্রতিবেশী : আর্চবিশপ লরেন্স গ্রেণার সিএসসি মুদ্রণ মাধ্যমের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং পাঠকবর্গের সুষ্ঠ সেবার্থে প্রতিবেশীকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপদানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরই নির্দেশে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ফাদার মাইকেল রোজারিও’র (প্রয়াত আর্চবিশপ) সম্পাদনায় নতুন সাপ্তাহিকটি প্রকাশিত হতে থাকে। এ মাসেই এর কার্যালয় পবিত্র ক্রুশ গির্জা থেকে বর্তমান ভবনে অর্থাৎ ৬১/১ সুভাষ বোস এভিনিউতে স্থানান্তরিত হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মত প্রতিবেশীর বহুবর্ণা বিশেষ বড়দিন সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পুনরায় সম্পাদক বদলের পালা। বড়দিন সংখ্যা থেকে নতুন সম্পাদক নিযুক্ত হন ফাদার পৌল গমেজ। তিনি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক টানা ১২ বছর সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ফাদার আলেকসিউস জ্যোতি গমেজ। তিনি ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সম্পাদক হন মি. যেরোম ডি’কস্তা। তিনি ছিলেন প্রথম খ্রিস্টভক্ত যিনি প্রতিবেশীর সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ হতে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই হতে পুনরায় সম্পাদক নিযুক্ত হন ফাদার আলেকসিউস জ্যোতি গমেজ। তিনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে হতে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেশীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ফাদার সুব্রত বনিফাস টলেন্টিনু সিএসসি। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর হতে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ফাদার কমল কোড়াইয়া। ফাদার জয়ন্ত এস. গমেজ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর হতে ১৯ অক্টোবর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আর ২০ অক্টোবর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু।
কোন কোন সম্পাদক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় পত্রিকা সম্পাদনার্থে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকগণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরা হলেন ফাদার যোসেফ পেরুমাত্তাম (১৯৪৩), ফাদার জর্জ আন্ডাচেরী (১৯৪৭), ফাদার যাকোব দেশাই (১৯৪৯-৫১), (১৯৬৬-১৯৭০), ফাদার পিটার এ. গমেজ (মন্সিনিয়র) (১৯৫৬-১৯৫৮), ফাদার ফ্রান্সিস গমেজ সীমা (মে ১৯৭০-আগস্ট ১৯৭৩) ফাদার মাইকেল অতুল রোজারিও সিএসসি ১৯৫৬ এপ্রিল থেকে ১৯৫৬ ডিসেম্বর। ফাদার যাকোব গমেজ ভুরা এককালে প্রতিবেশীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মি: যেরোম ডি. কস্তা ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রতিবেশীর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। উপ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন নিধন ডি’ রোজারিও (১৯৮০) ফ্রান্সিস গমেজ (১৯৮০) গডফ্রে প্রাণতোষ হালদার (১৯৮২) ফ্রান্সিস বালা (১৯৮২) সাইমন অমল ডি’নাথান (১৯৮৪) দীপক এফ. পালমা (১৯৮৬-২০০৪ মার্চ) জেন কুমকুম ডি ক্রুজ (২০০৫ জানু-২০০৭ ফেব্রুয়ারি) সুমন কোড়াইয়া (২০০৮-২০১০ জুন, ১২) উজ্জ্বল এ. গমেজ (২০১০ ডিসেম্বর, ১১ আগস্ট ২০১২)।
নেপথ্যে থেকে সম্পাদকদের ডানহাতরূপে যে সকল খ্রিস্টভক্ত বিভিন্ন সময়ে খেটেছেন তাদের মধ্যে আলেকজাণ্ডার গোমেজ, আন্দ্রেয়াস জে.গমেজ, ফ্রান্সিস গমেজ, মার্ক ডি’কস্তা, নিধন ডি’রোজারিও, হেবল ডি’ক্রুজ, জাখারিয়াস কস্তা, সিলভেস্টার সরোজ রোজারিও অন্যতম। মি. ফ্রান্সিস গমেজ ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে প্রতিবেশী’র সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্নে ফাদারগণই বেশীর ভাগ লেখা লিখতেন। তাদের মধ্যে ফাদার পিটার এ. গমেজ, ফাদার দামিয়েন রুরাম, ফাদার ক্লেমেন্ট রিছিল, ফাদার পিটার রেমা, ফাদার উর্বান কোড়াইয়া, ফাদার পল গমেজ, ফাদার টি.এ. গাঙ্গুলী, ফাদার মাইকেল রোজারিও, ফাদার মাইকেল অতুল ডি’রোজারিও, ফাদার যাকোব গমেজ, ফাদার যাকোব দেশাই, ফাদার এলিয়াস রিবেরু, ফাদার আলেকজান্ডার ডি’কস্তা, ফাদার থিয়োটনিয়াস গমেজ সিএসসি, সিষ্টার মেরী জর্জ এসএমআরএ প্রমুখ। এছাড়াও দীনবন্ধু বাড়ৈ, এস.বি লাহা, এফ.এক্স. জে খান, লুইস অতুল তরফদার, করুণাময় দত্ত, শশীভূষণ লাহা, ডা.উইলিয়াম খান, ক্ষিতিষ চন্দ্র সত্যব্রত, ভিনসেন্ট রড্রিক্স, এম হক, আন্দ্রেয়াস গমেজ, আগ্নেশ রিছিল, পিটার ডমিনিক রোজারিও, জেমস্ বার্ণাবাস খান, তেরেজা সাংমা, রাফায়েল গমেজ, শিশিলিয়া রিবেরু, বিজয় সাংমা, শিমন মজুমদার ও সনাতন গমেজ। পরবর্তীতে লেখেন ফাদার ফ্রান্সিস গমেজ সীমা, ফাদার আলেকসিউস জ্যোতি গমেজ, ফাদার আলবাট রোজারিও, ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা সিএসসি, ফাদার সুব্রত টলেন্টিনু সিএসসি, ফাদার বকুল রোজারিও সিএসসি, ফাদার জের্ভাস রোজারিও, ফাদার সুনীল রোজারিও। সেই সাথে চালু করা হয় বিভিন্ন ধর্মপল্লীর খবরা-খবর, হিতোপদেশসহ আরও কিছু বিভাগ। পরবর্তীতে ছোটদের আসর, মহিলাঙ্গন, জানা-অজানা, গাঁজার কল্কে, প্রসঙ্গ প্রপাত খুবই জনপ্রিয় বিভাগ ও কলাম ছিল। ফাদার জ্যোতি গমেজের সময়টা ছিল প্রতিবেশীর সুবর্ণকাল। স্বনামধন্য লেখক নিধন ডি’রোজারিও, মার্ক ডি’কস্তা, জাখারিয়াস কস্তা, সিলভেস্টার সরোজ রোজারিও, যেরোম ডি.কস্তা, ফ্রান্সিস গমেজ, হেবল ডি. ক্রুজ, হেলেন গোমেজসহ আরও একঝাঁক উদীয়মান লেখক সেই সময় প্রতিবেশীকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
বাংলাদেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকাই দীর্ঘ সময় সগৌরবে টিকে আছে। তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রতিবেশী অন্যতম। বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলেও প্রতিবেশী খ্রিস্টীয় শিক্ষা সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে জোড়ালো ভূমিকা রাখার কারণে হয়েছে দারুণভাবে আক্রান্ত। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ অঞ্চলে মান্দি আদিবাসীদের উপর যখন অন্যায় অত্যাচার শুরু হয় তখন তৎকালীন আর্চবিশপ লরেন্স লিও গ্রেনার এর নির্ভীক প্রতিবাদ প্রতিবেশীতে ছাপা হয়েছে এর সচিত্র প্রতিবেদনসহ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দেও প্রতিবেশীর ভূমিকা কোনভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চের পর যুদ্ধের কারণে প্রতিবেশী প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। কারণ তখন জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর স্বাধীন দেশে নতুন করে শুরু হয় পথচলা। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্র“য়ারি সংখ্যা প্রথম প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ঘটনাবলী প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন সময়ে ফাদার পৌল গমেজ ছিলেন সম্পাদক। তার অবর্তমানে ফাদার ফ্রান্সিস গমেজ সীমা প্রতিবেশীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭০ হতে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রে যোগদান করেন। প্রতিবেশী তখন বাইরে থেকে কম্পিউটার কম্পোজ ও প্লেট বানিয়ে জেরী প্রিন্টিং-এ ছাপানো হতো। তখন উপ-সম্পাদক দীপক এফ. পালমা। এ সময় কেন্দ্রে মাত্র একটি অফসেট প্রিন্টিং মেশিন ছিল। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আরো দুটি অফসেট মেশিন জার্মানী থেকে আমদানী করা হলো। উদ্দেশ্য ছিল প্রেসের আয় দিয়ে প্রতিবেশীর ঘাটতি পূরণ করা। খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের পরিচালক ফাদার সুনীল রোজারিও এবং প্রতিবেশীর সম্পাদক ফাদার সুব্রত বনিফাস টলেন্টিনু সিএসসি তখন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। সিদ্ধান্ত হয় প্রতিবেশী ট্যাবলয়েড আকার থেকে ম্যাগাজিন আকারে ২৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা হবে। খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কমিশনের পরামর্শ নিয়ে কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালীন অধিবেশনে সেই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেন। সে বছরই আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দিবস থেকে প্রতিবেশী ম্যাগাজিন আকারে যাত্রা শুরু করে।
ভাতিকান মহাসভার নির্দেশাবলীর আলোকে প্রতিবেশীর প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশের আগে তিনটি মূলনীতি মাথায় রাখতে হয়। যেমন: ১. কাথলিক চার্চের শিক্ষাসমূহ সঠিকভাবে পরিবেশন করা; ২. দেশের সর্বত্র এবং দেশের বাইরে যারা বাস করছেন প্রতিবেশীর মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সেতুবন্ধন বজায় রাখা; ৩. দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি রক্ষা করা। সেই সঙ্গে প্রতিবেশীর মাধ্যমে নতুন লেখক সমাজ গড়ে তোলা। বয়স যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবেশীর দেহ অবয়বের নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। অনিয়মিত পত্রিকা থেকে নিয়মিত মাসিক, সাপ্তাহিক। ম্যাগাজিন সাইজ থেকে টেবলয়েড সাইজ তারপর আবার ম্যাগাজিন সাইজ। রাণীখং থেকে ঢাকার লক্ষ্মীবাজার হলিক্রস ক্যাথিড্রাল, তারপর সুভাষ বোস এভিনিউতে এর বর্তমান অবস্থান। হাতের মুদ্রণ ছোট যন্ত্র থেকে, ধাতব অক্ষর, এখন কম্পিউটারাইজড অফসেট মেশিনে ছাপা। কভার এক রং থেকে চার রঙা। বিনামূল্যে যাত্রা শুরু তারপর বার্ষিক দুই আনা, দশ টাকা, পঁচিশ টাকা থেকে এখন তিন শত টাকা বার্ষিক চাঁদা। গ্রাহক সংখ্যা একশ থেকে এখন ৮ হাজারের বেশী। দিনে দিনেই বাড়ছে প্রতিবেশীর চাহিদা, পরিবর্তন হচ্ছে এর আঙ্গিক। জীবন্ত প্রতিবেশী এভাবেই এক পা দু’পা করে ৭৯ বছরে পা দিয়েছে।
মঙ্গলসমাচারের মূল্যবোধ প্রচার ও তাতে জীবনযাপন করা ‘সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’র অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমাদের সকল কাজের ও প্রচারের শক্তি এই মঙ্গলবাণী। ‘সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’ আমাদের গর্ব, আনন্দ ও প্রত্যাশার বস্তু। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে পত্রিকাটি টিকে আছে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে। কত দুর্লভ ছবি, তথ্য ও লেখা বুকে ধারণ করে নীরব ‘সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’ এখনো চলছে আগামীর লক্ষ্যে।