প্রতিবেশী ডেস্ক : ১০ এপ্রিল ২০২১ খ্রিস্টাব্দ অস্ট্রেলীয় মণ্ডলীসহ বিশ্বমণ্ডলী খ্রিস্টীয় ঐক্য কাউন্সিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কার্ডিনাল এডুয়ার্ড ইদ্রিস ক্যাসিডির মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট আর্চবিশপ মার্ক কলেরিডজ বলেন, কার্ডিনাল ক্যাসিডি শুধু কূটনৈতিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাই দেখাননি; তিনি মানবিক সততা ও সাধারণ জ্ঞানও প্রকাশ করেছেন। তাঁর সবকিছুতে সারল্য ছিল – মণ্ডলীর একজন কর্তৃপক্ষস্থানীয় ব্যক্তির সেই সরলতা যার চোখ দুটি যিশুতে স্থির ছিল।
কার্ডিনাল ক্যাসিডি ৫ জুলাই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে নিউ সাউদ ক্যাসেল, সিডনীতে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তার দাদু মারা যায় তখন কার্ডিনাল ক্যাসিডির পরিবার আর্থিক সমস্যায় পতিত হলে তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়ে সড়ক পরিবহন সেক্টরে একজন জুনিয়র ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাসিডি তার বিশপকে রাজি করান পুরোহিত হবার লক্ষ্যে সেমিনারীর পড়াশুনা করতে তাকে অনুমতি দিতে এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেমিনারীতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ২৫ বছর বয়সে তিনি পুরোহিত হন। কয়েকবছর পরই ওয়াগ্গা ডায়োসিসে পরিবর্তিত হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইন শাস্ত্র কার্ডিনাল ক্যাসিডির পড়তে রোমে আসেন এবং ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পন্টিফিক্যাল লাতেরান ইউনিভার্সিটি থেকে আইন শাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।
পুরোহিত হিসেবে কার্ডিনাল ক্যাসিডি ইণ্ডিয়া, আয়ারল্যাণ্ড ও পর্তুগালে কাজ করেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পোপীয় ডেলিগেট হিসেবে আমেরিকাতে যাওয়ার কথা থাকলেও আয়ারল্যাণ্ডে পোপের প্রতিনিধি পরিবর্তন হয়ে গেলে তাকে আয়ারল্যাণ্ডের রাজধানী ডাবলিনেই থাকতে হয়। তবে কয়েকমাস পরেই তিনি আল-সালভাদোরের পোপের প্রতিনিধির কাউন্সিলর হয়ে সেদেশে যান। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে চীনে প্রো-নুনন্সির’র দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি আর্জেন্টিনাতে পোপের প্রতিনিধির কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ভাতিকানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পোপের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে পোপের প্রতিনিধি হিসেবে কার্ডিনাল ক্যাসিডিই প্রথম দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়েই বাংলাদেশ খ্রিস্টমণ্ডলী বিশ্বমণ্ডলীতে ধীরে-ধীরে পরিচিত হতে থাকে। বিশপ থিওটোনিয়াস গমেজ সিএসসি’র বিশপীয় অভিষেকের সময় তিনি প্রয়াত আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও’র সাথে দিনাজপুরে উপস্থিত ছিলেন। বিশপ থিওটোনিয়াস জানান, কার্ডিনাল ক্যাসিডি বাংলাদেশ মণ্ডলীকে খুব ভালবাসতেন। অনেকেই তাঁর কাছে ও তাঁর বাসভবনে যেতে পারতেন। বাংলাদেশ মণ্ডলী ও ভাতিকানের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার ভিত তিনিই রচনা করেন। সর্বশেষ তেজগাঁও নতুন গির্জার উদ্বোধনের সময় ২২ জানুয়ারি ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশের বেশকিছু যুবককে পড়াশুনা ও জীবন উন্নয়নের জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ মণ্ডলীর বন্ধু কার্ডিনাল ক্যাসিডি। সেই যুবকদের মধ্যে আছেন – কারিতাস এশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও কারিতাস বাংলাদেশের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ড: বেনেডিক্ট আলো রোজারিও, রাজশাহীর মার্সেল কস্তা, মঠবাড়ীর সুনীল জর্জ কস্তা ও নাগরীর ছাইতান গ্রামের ইঞ্জিনিয়ার সেবাস্টিয়ান পিউরিফিকেশন, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী।
বাংলাদেশের পরে লেসথো ও নেদারল্যাণ্ডে প্রো-নুনন্সিও এবং দক্ষিণ আফ্রিকা যখন বর্ণবাদে আক্রান্ত তখন তিনি সেখানে ৫ বছর পোপের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর খ্রিস্টীয় ঐক্য বৃদ্ধি বিষয়ক পোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান এবং একই সাথে ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ক কমিশনের প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সাধু পোপ ২য় জন পল তাঁকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টীয় ঐক্য বিষয়ক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। অবশেষে ১০ এপ্রিল ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ৯৬ বছর বয়সে তিনি স্বর্গবাসী হন।
অস্ট্রেলিয়ান বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট আর্চবিশপ মার্ক কলেরিডজ স্মৃতিচারণ করে বলেন, কার্ডিনাল ক্যাসিডি বন্ধুবৎসল ও সকলের সাথে মিশতে পারা একজন দারুণ ব্যক্তিত্ব; বিশেষভাবে খ্রিস্টীয় ঐক্য দপ্তরে থেকে তিনি তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। সিডনীর আর্চবিশপ আন্তুনী ফিসার, ওপি এক শোকবার্তায় বলেন, কার্ডিনাল ক্যাসিডি মণ্ডলীতে চমৎকার উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। বিশেষভাবে আন্তমাণ্ডলীক ক্ষেত্রে। খুব কম অস্ট্রেলিয়ানই আছেন যারা মাণ্ডলীক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন প্রভাব ফেলতে পেরেছেন এবং আশা করি সামনের দিনগুলোতেও তিনি মণ্ডলীর নেতৃবর্গকে অনুপ্রাণিত করবেন। এদিকে মেলবোর্ণের আর্চবিশপ পিটার কমেনসলি স্মৃতিচারণ করে বলেন, কার্ডিনাল ক্যাসিডি ছিলেন ঈশ্বর এবং মণ্ডলীর এক বিশ্বস্ত সেবক ও দারুণ অস্ট্রেলিয়ান। বাংলাদেশী অনেক খ্রিস্টভক্তও তাদের প্রিয় এই ব্যক্তিকে হারিয়ে শোক প্রকাশ করছে। ঈশ্বর তাঁর এই মহান সেবককে অনন্ত শান্তি দান করুন।