ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশীয় ১৮তম পালকীয় সম্মেলন-২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গত ২৫-২৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সিনোডাল মণ্ডলী:বিশ্বাস, প্রার্থনা সাক্ষ্যদান – এই মূলসুরের  আলোকে ঢাকা আর্চবিশপ ভবনে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশীয় ১৮তম পালকীয় সম্মেলন- ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১ জন আর্চবিশপ, ১ জন মনোনীত বিশপ, ৫৫ জন যাজক, ২ জন ডিকন, ৫ জন ব্রাদার, ৪৯ জন সিস্টার ও ১৪৮ জন খ্রিস্টভক্তসহ; সর্বমোট ২৬১ জন অংশগ্রহণ করে।

২৫ এপ্রিল ২০২৪, বিকাল ৫টায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে পালকীয় সম্মেলন শুরু হয়। শুরুতেই স্বাগত নৃত্যের মধ্য দিয়ে সবাইকে বরণ করে নেওয়া হয়। ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল আর্চবিশপ বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই স্বাগত বক্তব্যে সিনোডাল মণ্ডলীর উপর আলোকপাত করে বলেন, খ্রিস্টমণ্ডলী মিলন সমাজের বীজ বপন করে চলেছে। আমরা যদি বিশ্বাসের চর্চা করি, তাহলে সে বিশ্বাস আমাদের একত্রিত করবে। বিশ্বাস, প্রার্থনা ও সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে মণ্ডলীতে মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ- এই তিনটি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে।

স্বাগত বক্তব্যের পর থাকে অঞ্চল ও কমিশন ভিত্তিক পরিচয় পর্ব। এ সময় আর্চবিশপ মহোদয় সবাইকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা প্রদান করেন। পরিচয় পর্ব সমাপ্ত হলে বিগত পালকীয় সম্মেলনের প্রতিবেদন, বিগত বছরের বিভিন্ন কমিশনের কার্যক্রমের প্রতিবেদন (২০২২-২০২৩) ও পালকীয় অঞ্চলসমুহের প্রতিবেদন পেশ করা হয়। রাতের খাবারের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।

২য় দিন ২৬ এপ্রিলের শুরুটা হয় সম্মিলিত প্রার্থনার মধ্যদিয়ে। সকাল ৮:১৫ মিনিটে সিনোডাল মণ্ডলী: বিশ্বাস, প্রার্থনা সাক্ষ্যদান এ বিষয়ে মূল উপস্থাপনা রাখেন আর্চবিশপ বিজয় এন, ডি’ক্রুজ। সহভাগিতায় তিনি বলেন, সিনোডাল মণ্ডলী হলো মিলন সমাজ, যেখানে সবার অংশগ্রহণ এবং একটা মিশন বা প্রেরণ দায়িত্ব রয়েছে। যেখানে সবাইকে একসাথে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাস হল ঈশ্বরের একটি মহাদান, একটি উপহার। এটি বৃদ্ধি পায় চর্চার মধ্য দিয়ে। চর্চা না করলে তা হারিয়ে যায়। যাদের বিশ্বাস বেশি ঈশ্বর তাদেরকে স্পর্শ করেন। এই বিশ্বাসের ফলেই আসে আমাদের প্রার্থনা জীবন আর এই প্রার্থনা জীবন থেকেই আমরা জীবন সাক্ষ্য দান করতে পারি।

মূল বিষয়টিকে আরো বেশি ব্যাপক ও গভীর চিন্তন দান করার লক্ষ্যে ফাদার জয়ন্ত এস গমেজ, ভিডিও চিত্র ও বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের মধ্যদিয়ে‘বিশ্বাস’ এবং সিস্টার বেনেডিক্টা এসএমআরএ ‘প্রার্থনা’-র উপর উপস্থাপনা রাখেন। ‘সাক্ষ্যদান’ বিষয়ের উপর জীবনভিত্তিক সহভাগিতা করেন তিতাস-চিত্রা রোজারিও দম্পতি। তারা বলেন- ‘পরিবার থেকে তারা যে খ্রিস্টবিশ্বাস লাভ করেছেন তা তাদের কর্মক্ষেত্রসহ সকল স্থানে বিভিন্ন মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারছেন ও তা অব্যাহত রাখবেন’। এরপর থাকে প্রশ্নোত্তর পর্ব। অংশগ্রহণকারীগণ বক্তাদের নিকট বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে।

দুপুরে ৮টি দলে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণকারীগণ দলীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং  দলীয় আলোচনার প্রতিবেদন ও গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। বিকালে ‘কাথলিক ধর্মাবলম্বীর জীবন ও কার্যক্রম সম্বন্ধে অন্য মণ্ডলী এবং অন্য ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব’ – এ বিষয়ের উপর সহভাগিতা করেন প্রফেসর অনিমেষ কুমার সাহা, কাজী রায়হান জামিল ও রেভা. ডেভিড দাস। প্রফেসর অনিমেষ তাঁর সহভাগিতায় বলেন, পরধর্ম সহিষ্ণুতা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ সমবায়ের মাধ্যমে দেশ এবং ব্যক্তির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। রেভা. ডেভিড দাস প্রটেস্ট্যান্ট মণ্ডলীর পক্ষে তার সহভাগিতা বলেন, আন্তঃমাণ্ডলিক ও আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাথলিক মণ্ডলী খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছে। অন্য ধর্মের লোকদের সাথে আমাদের শুধু বাহ্যিক সম্পর্ক থাকলে হবে না, আমাদের আত্মিক সম্পর্কও গড়ে তুলতে হবে। অন্য মণ্ডলী বা অন্য ধর্মের লোকদের সাথে আত্মিক ও সামাজিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে পুণ্যপিতা যে বাণী দিচ্ছেন তা বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং খুবই ফলপ্রসূ। তিনি আরও বলেন-খ্রিস্টানরা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেক জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। দেশ গড়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও খ্রিস্টানেরা অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। কাজী রায়হান জামিল বলেন, মানুষ জন্ম থেকে ধর্মের আশ্রয়েই থেকেছে, কিন্তু আজও কোনো এক ধর্মমতে ঐক্য প্রকাশ করতে পারে নি। অধিকাংশ মানুষই শান্তি প্রিয়, কিন্তু মানুষ অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু। যা অন্য ধর্মের ও মণ্ডলীর ভাইবোনদের সাথে একত্রে পথ চলতে অনুপ্রাণিত করছে না। সন্ধ্যায় পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন ফাদার সুব্রত বি. গমেজ, মনোনীত বিশপ। তিনি তার উপদেশ বাণীতে  সাক্রামেন্তের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।

২৭ এপ্রিল, ৩য় দিনের কার্যক্রম যথারীতি প্রার্থনার মধ্যদিয়ে। সকাল ৮:১৫ মিনিটে  অগ্রাধিকার নির্ণয় ও প্রেরণবাণী উপস্থাপন হলে সকলে আলোচনায় অংশ নেন এবং তা চূড়ান্ত করেন অগ্রাধিকার নির্ণয় ও প্রেরণবাণী কমিটি। এরপর ধর্মপ্রদেশে উপাসনা; বিবাহ ও পারিবারিক জীবনের বাস্তবতা নিয়ে সময়োপযোগী উপস্থাপনা রাখেন যথাক্রমে ফাদার পিটার শ্যানেল গমেজ ও ফাদার মিন্টু এল, পালমা। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন প্রশ্ন করে বিষয়গুলোতে আরো স্পষ্টতা আনয়ন করেন। সম্মেলনের শেষদিকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে দুইজন বিগত তিন দিনের অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করেন। অতঃপর সম্মেলনের সমন্বয়কারী ধর্মপ্রদেশের চ্যান্সেলর ফাদার মিল্টন কোড়াইয়া সবাইকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আর্চবিশপ মহোদয় খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন। খ্রিস্টযাগের শেষে  চার অঞ্চলের চারজন প্রতিনিধির হাতে প্রজ্জলিত প্রদীপ প্রদানের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলে প্রেরণ করেন। দুপুর ১টায় প্রীতিভোজের মধ্যদিয়ে এই পালকীয় সম্মেলনের সমাপ্তি হয়।

সংবাদদাতা: নিজস্ব প্রতিবেদক